Michael Madhusudan Dutt

দুই শতক পরেও শহরে ‘গৃহহীন’ মাইকেল

অধ্যাপক শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, “রামমোহন, বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবর্ষেও রাজ্যে বা দেশে উদ্‌যাপন কমিটি দেখা গিয়েছিল। মাইকেলের ক্ষেত্রে তেমন কিছু হল কই! তিনি যেন এ শহরে ঘরহারা।”

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৪ ০৫:৫২
Share:

অবহেলা: খিদিরপুরে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ির বর্তমান অবস্থা। বুধবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

রাম নয়, রাবণই যে তাঁর প্রিয়, তা বলতে কসুর করতেন না তিনি। তবে, বাঙালির রামায়ণ চর্চার কথা ভাবলে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা মনে পড়বেই। আজ, বৃহস্পতিবার ২০০ বছরের জন্মদিনেও কার্যত ধুলোয় ঢাকা ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর কবির স্মৃতি। মধুসূদন মঞ্চে সরকারি অনুষ্ঠান যা হচ্ছে। খিদিরপুরে মধুকবির প্রথম যৌবনের আবাস, একদা পৈতৃক বাড়িটিও অনাদরে মাইকেলপ্রেমীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

Advertisement

উনিশ শতকের বাংলা ও বাঙালি বিষয়ক গবেষক, অধ্যাপক শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, “রামমোহন, বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবর্ষেও রাজ্যে বা দেশে উদ্‌যাপন কমিটি দেখা গিয়েছিল। মাইকেলের ক্ষেত্রে তেমন কিছু হল কই! তিনি যেন এ শহরে ঘরহারা। জন্মদিনে আমরা ক’জন মল্লিকবাজারের সমাধিক্ষেত্রের স্মৃতিসৌধটুকুতেই শ্রদ্ধা জানাই।” ক’দিন আগে খিদিরপুর এলাকার একটি ঐতিহ্য-সফরে মাইকেলের পারিবারিক বাড়িটিতে ভিড় করা দর্শনার্থীদেরও কার্যত ঘাড়ধাক্কা দেন বর্তমান মালিকের নিরাপত্তারক্ষীরা। বর্তমানে ২০বি কার্ল মার্ক্স সরণির বাড়িটিতে গিয়ে দেখা গেল, সামনে রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের একটি ফলক। ভিতরে সাবেক বাড়ির অংশে ঝিলমিল বসানো বারান্দা বা ছাদে ওঠার লোহার সিঁড়িতে প্রাচীনত্বের গন্ধ। উঠোনে কিছুটা খোলা জমি। আর বাকি অংশে জামাকাপড় তৈরির ব্যস্ত কারখানা, রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের কয়েকটি ঘর।

নগেন্দ্রনাথ সোম বা গোলাম মুরশিদের মাইকেল-জীবনী, বন্ধু গৌরদাস বসাক, রাজনারায়ণ বসুদের সঙ্গে পত্রালাপে তৎকালীন সার্কুলার গার্ডেনরিচ রোডের ওই বাড়ির কথা এসেছে। বিশ শতকের গোড়ায় ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় খিদিরপুরের বাড়ির একটি আঁকা ছবিও বেরোয়। যার সঙ্গে মিল রয়েছে আজকের ‘বেদখল’ বাড়িটির। নানা সাক্ষ্য বলছে, মাইকেল সম্ভবত ১৮৩৬ থেকে ১৮৪৩ সালের এপ্রিলে, তাঁর খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের সময় পর্যন্ত খিদিরপুরের বাড়িতে ছিলেন। মাইকেলের বাবা রাজনারায়ণ দত্তের প্রয়াণ ১৮৫৫-য়। তার পরে জ্ঞাতিরা বাড়ির দখল নিতে নামেন। খবর পেয়ে বন্ধু গৌরদাস বসাক খিদিরপুরের বাড়িতে বসেই মাদ্রাজে (বর্তমানে চেন্নাই) মাইকেলকে চিঠি লিখে সব জানান। মাইকেল তাঁর যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময় খিদিরপুরের বাড়িতেই কাটিয়েছেন বলে ওই চিঠিতে গৌর আক্ষেপ করেছেন। মাইকেল কলকাতায় ফিরে সেই বাড়ি উদ্ধারে মামলা লড়েন। নিজের মালিকানা অর্জন করেন। ১৮৬১ নাগাদ বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়ার টাকা জোগাতে বন্ধু হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে (কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই) বাড়িটি বিক্রি করেন মাইকেল।

Advertisement

নানা হাতবদলের পরে খিদিরপুরের ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন বাড়িটি কেনেন। বুধবার জানা গেল, সালাউদ্দিন মারা গিয়েছেন। ভাইপো আতিক রহমান ওই বিষয়-সম্পত্তি দেখাশোনা করছেন। পুরসভার ঐতিহ্য-তালিকায় মাইকেলের বাড়ি এখনও গ্রেড-টুএ। যা ভাঙা যায় না। বড়জোর মূল ভবনটি আড়াল না-করে লাগোয়া অংশে কিছু গড়া যেতে পারে। তবে, বাড়িটি ভেঙে নতুন নির্মাণের আশায় মাইকেল-যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলে সালাউদ্দিন ২০১৬-য় হাই কোর্টে মামলা করেন। রাজ্য হেরিটেজ কমিশন তখন খোঁজখবর করে দেখে, মাইকেলের আমলে বাড়িটির কেনাবেচার কোনও নথি নেই। তবে, বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য ওই তল্লাটে ফলক এবং মাইকেলের মূর্তি বসানোরও প্রস্তাব দেয় কমিশন। সে সব কিছুই হয়নি। কেন? পুর কর্তৃপক্ষের কাছে এর সদুত্তর নেই।

বাড়ি গিয়ে দেখা করার চেষ্টা এবং বার বার ফোন করা সত্ত্বেও আতিক রহমানের নাগাল মেলেনি। মাইকেল-অনুরাগীদের আশঙ্কা, বাড়িটি ভেঙে ফেলার পথই প্রশস্ত করা হচ্ছে। উনিশ শতকের একটি বাড়ি দুম করে ভাঙার অধিকার নিয়েও ঐতিহ্যপ্রেমীদের প্রশ্ন রয়েছে। শক্তিসাধনের কথায়, “বাড়ির নথি লোপাট করাও হতে পারে। মাইকেলের বসবাস করা অন্য ভাড়া বাড়িগুলির খোঁজ পাওয়াও জটিল। এই স্মৃতিটুকু রাখা না-গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যাবে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement