দামি উপহারের টোপে রক্তদানের ‘সিন্ডিকেট’

জমি-বাড়ির সিন্ডিকেট নিয়ে অভিযোগ তো ছিলই। এ বার রক্তদান শিবির ঘিরেও সিন্ডিকেট চালু হওয়ার অভিযোগ উঠল। অভিযোগ, বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থার কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করে নানা এলাকায় ঘটা করে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করছে বেশ কিছু সংগঠন।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৬ ০২:৩০
Share:

জমি-বাড়ির সিন্ডিকেট নিয়ে অভিযোগ তো ছিলই। এ বার রক্তদান শিবির ঘিরেও সিন্ডিকেট চালু হওয়ার অভিযোগ উঠল। অভিযোগ, বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থার কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করে নানা এলাকায় ঘটা করে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করছে বেশ কিছু সংগঠন। আবার ওই একই ক্যাম্পের নাম করে এলাকা থেকেও দেদার টাকা তোলা হচ্ছে। তার পরে সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কের পরিবর্তে সেই রক্ত বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে বিক্রি করা হচ্ছে। গত কয়েক মাসে এমন একাধিক লিখিত অভিযোগ স্বাস্থ্য ভবনে জমা পড়েছে। এলাকার ছোট কোনও ক্লাব রক্তদান শিবির করতে চাইলে তাদের কার্যত দাবিয়ে রাখা হচ্ছে বলেও অভিযোগ।

Advertisement

সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে এমন বেশ কিছু অভিযোগ আসার পরে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে স্বাস্থ্যকর্তাদের কড়া নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। রক্তের মতো জীবনদায়ী বিষয়কে ঘিরে কোনও রকম ‘দাদাগিরি’ যাতে বরদাস্ত করা না হয়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। রক্তদান শিবিরকে ঘিরে টাকা আদায়ের চেষ্টা বন্ধের ব্যাপারে অবিলম্বে পদক্ষেপ করতেও বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, কলকাতা ও শহরতলির একাধিক জায়গাতেই বিভিন্ন ক্লাব নানা বাণিজ্যিক সংস্থা থেকে রক্তদান শিবিরের জন্য মোটা টাকা আদায় করছে বলে অভিযোগ। তার পরে সেই টাকায় মূল্যবান উপহার দিয়ে বেশি সংখ্যক দাতাও জোগাড় করছে তারা। কিন্তু সংগৃহীত রক্ত সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ককে না দিয়ে পাঠানো হচ্ছে বেসরকারি ব্যাঙ্কে, যা চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। রক্তের উপাদান বিভাজন করে এক একটি ইউনিট থেকেই তিন গুণ আয় হচ্ছে। আয়োজনকারীরা শিবির-বাবদ সংগ্রহ করা টাকার একটা বড় অংশও যেমন নিজেদের পকেটে ভরছে, তেমন রক্ত বিক্রি করা টাকাও যাচ্ছে তাদের ভাঁড়ারেই। আরও অভিযোগ, নিজেদের দাপট বজায় রাখতে এলাকার ছোট ক্লাবগুলিকে এই ধরনের কোনও শিবির করতে দিচ্ছে না তারা।

Advertisement

রক্তের এই সিন্ডিকেটের অন্যতম হাতিয়ার শিবিরগুলিতে দেওয়া দামি উপহার। এর জেরে অনেকেই রোগ গোপন করে কিংবা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধান না মেনেই রক্ত দিতে চলে আসছেন। রাজ্যের সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের অধিকর্তা কুমারেশ হালদার বলেন, ‘‘রক্তে সিন্ডিকেট-রাজ চালু হওয়াটা খুব বিপজ্জনক। কিন্তু এটা কী ভাবে ঠেকানো যাবে, তা আমাদের কাছেও স্পষ্ট নয়। রক্তদান শিবিরকে কেন্দ্র করে প্রচুর টাকা উঠছে। আর সেই টাকায় বেশি দাতা জোগাড় করতে উপহারের প্রথা চালু করে আরও সর্বনাশ করে দেওয়া হচ্ছে। আমরা লাগাতার প্রচার করে চলেছি, ‘উপহার দেবেন না, উপহার নেবেন না’। তা-ও কাজের কাজ বিশেষ কিছু হচ্ছে না।’’

স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘আমাদের কাছে পরপর অভিযোগ আসছে। যেমন, টালিগঞ্জের একটি মাঠে প্যান্ডেল করে বিশাল রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেছিল স্থানীয় একটি বড় সংগঠন। স্থানীয় এক প্রোমোটরের টাকায় আয়োজিত ওই ক্যাম্পে রক্তদান করেন ২১০০ জন। প্রত্যেককে একটি করে ট্রলি ব্যাগ উপহার দেওয়া হয়। একই দিনে আশপাশের কয়েকটি পাড়ায় রক্তদান শিবির করতে চেয়েছিল কয়েকটি ছোট ক্লাব। তারা অনুষ্ঠানের লিফলেটও ছাপিয়ে ফেলেছিল। ভয় দেখিয়ে তাদের শিবির বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে।’’ স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন— এখন বহু বেসরকারি ক্যাম্পেই রক্তদাতাদের কোনও কার্ড দেওয়া হচ্ছে না, যা থেকে তাঁরা পরবর্তী সময়ে নিখরচায় রক্ত পেতে পারেন।

স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, ওই সব শিবিরে দামি উপহার পেয়ে রক্তদাতারাও খুশি মনে কার্ড না নিয়েই চলে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা বড় অংশের আশঙ্কা, এর ফলে ছোট-ছোট ক্লাব যাদের আর্থিক সামর্থ্য বিশেষ নেই, উপহারের ব্যবস্থা করতে না পারায় তাদের শিবির মার খাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, এর জেরে কয়েক দশক ধরে রাজ্যে গড়ে ওঠা রক্তদান আন্দোলনই বহু গুণ পিছিয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট অনেকেরই। এ রাজ্যে যখন রক্তের আকাল ভয়াবহ আকার নিচ্ছে, তখন এই প্রবণতা ঠেকাতে না পারলে তা স্বাস্থ্য পরিষেবাকে আরও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে বলে ভয় পাচ্ছেন তাঁদের অনেকেই।

রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মী দীপঙ্কর মিত্র বলেন, ‘‘রক্তদান শিবিরকে ঘিরে রীতিমতো দাদাগিরি চলছে বিভিন্ন জায়গায়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মোটা টাকার খেলা। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হল— এর ফলে বিষয়টা এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে, মনে হচ্ছে রক্তদান শিবির করতে গেলেই বিশাল জাঁকজমক করতে হবে, বিরিয়ানি খাওয়াতে হবে, দামি উপহার দিতে হবে। ছোট ক্যাম্প ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। এটা খুব ক্ষতিকর।’’

স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, এই সব বড় শিবিরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা মেডিক্যাল কলেজগুলো থেকে তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ষের পড়ুয়াদের একাংশকে ডাক্তার সাজিয়ে নিয়ে যায়। ফলে রক্ত দেওয়ার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টিও বহু ক্ষেত্রেই যথাযথ হয় না।

কেন এ ব্যাপারে কড়া নজরদারি চালু হচ্ছে না? স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘এটা খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। সতর্ক হয়ে এগোতে হবে। পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement