আড়াল: জনবহুল এলাকায় এ ভাবেই পর্দার অন্তরালে সাট্টা চলে বলে অভিযোগ। দমদম গোরাবাজারের এস পি মুখার্জি রোডে। নিজস্ব চিত্র।
রেলগেট পার হয়ে ডান দিকে তাকালে চোখে পড়বে একচিলতে গুমটি। পর্দা ঝুলছে। ভিতরে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করতেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন এক যুবক, ‘‘কী দেখছেন? এখানে কিছু নেই। যান এখান থেকে।’’ এই অভিজ্ঞতা শনিবার সন্ধ্যায় দমদম ক্যান্টনমেন্টের একটি রেলেগেটের কাছে ।
এলাকার খবর, ওই পর্দার আড়ালে চলে সাট্টা। অথচ, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। স্থানীয় মানুষের এ-ও অভিযোগ, দমদম, বাগুইআটি, চিনার পার্ক, মধ্যমগ্রাম, নিউ ব্যারাকপুর-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় সিন্ডিকেট চাঁইদের কালো টাকা এখন লগ্নি হচ্ছে সাট্টার ব্যবসায়। সিন্ডিকেটের মতো কালো টাকার বড় লভ্যাংশ এই ব্যবসায় সরাসরি জনপ্রতিনিধিদের হাতে পৌঁছয় না। ভোটের সময়ে জনপ্রতিনিধিদের হয়ে যাঁরা ‘ভোট করেন’, তাঁদের একটি বড় অংশই বহু জায়গায় এই ব্যবসার নিয়ন্ত্রক। সেই ভোট এবং এলাকায় আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে জনপ্রতিনিধিরাও এ সব নিয়ে কাউকে বিশেষ ঘাঁটাতে চান না বলেই খবর।
এক সময়ে সিন্ডিকেটের কালো টাকা দমদম, বিধাননগর, রাজারহাট, বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের মতো এলাকার ডান্স বারে খাটত। সে সবের আড়ালে নর্তকী পাচারের ব্যবসা করতে গিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কেউ কেউ গ্রেফতারও হয়েছিলেন। তার পরে ওই সব তল্লাটে ডান্স বার বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। এখনও সেগুলি বন্ধ। কিন্তু সিন্ডিকেট ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে।
দমদমের ২ নম্বর রেলগেট, গোরাবাজার এলাকায় একটু সজাগ হয়ে ঘুরলেই দেখা যাবে ভাঙা দরজা, নোংরা পর্দা ঝোলানো ছোট ছোট ঘর। দমদমের পাশের এলাকা বিধাননগরের মহিষবাথান, পোলেনাইট, কেষ্টপুর, তিন নম্বর, যাত্রাগাছি, সাপুরজি, নারায়ণপুরের মতো এলাকাতেও চোখে পড়বে এই ধরনের গুমটির ছবি।
সে সব দেখেই এলাকার মানুষের প্রশ্ন, তবে কি ডান্স বারের ব্যবসা বন্ধের পরে শেষ কয়েক বছর সিন্ডিকেটের টাকা খাটছে সাট্টা বাজারে?
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, দমদম এলাকায় এক দশক আগে এক ব্যক্তির সাট্টার রমরমা কারবার ছিল। রাজ্যে পালাবদলের কিছু দিন পরে তিনি মারা যান। তাঁর পরিবারের সদস্যেরা বিরাট কারবার সামলাতে না পেরে দমদমের বাসিন্দা দুই নেতাকে ব্যবসার একটি বড় অংশ বিক্রি করে দেন। যদিও একটি সূত্রের খবর, ওই দুই নেতার উপরেও রয়েছেন অনেক বড় বড় মাথা। ব্যবসার মূল লভ্যাংশ প্রধানত পৌঁছয় তাঁদের কাছেই। সবটাই ঘটে সিন্ডিকেট পদ্ধতিতে। সব এলাকাতেই ব্যবসায়ীদের টিকি বাঁধা থাকে কোনও না কোনও দাপুটে নেতার হাতেই।
যাঁরা খেলতে আসেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আগে এই ব্যবসা মূলত মুম্বই থেকে নিয়ন্ত্রিত হত। দাউদ ইব্রাহিমের লোকজন মুম্বই থেকে নিয়ন্ত্রণ করত দমদমের সাট্টা কারবার! তখন দিনে দু’বার খেলা হত। কিন্তু গত কয়েক বছরে দিনে সাত-আট বার খেলা হয় বলে খবর। তবে এখনও দমদম এবং অন্যত্র এই সাট্টা মুম্বই থেকেই পরিচালিত হয় কি না, তা কেউ স্পষ্ট করতে পারেননি।
কারা আসেন খেলতে?
মূলত অটোচালক, টোটোচালক, রিকশাচালক, মিস্ত্রি-সহ নিম্নবিত্তের পেশার সঙ্গে জড়িত লোকজনেরই ভিড় হয় ওই সব ঠেকে। তবে এলাকার বাসিন্দারা জানান, ধোপদুরস্ত পোশাকের লোকজনকেও দেখা যায় নম্বর মেলাতে আসতে। স্থানীয়দের অভিযোগ, সব কিছুই ঘটছে চোখের সামনে। কিন্তু মাসোহারা পৌঁছে যাওয়ায় চোখ বন্ধ সব মহলেরই। এমনই একটি ঠেকে খেলতে আসা এক টোটোচালক জানান, তিনি প্রায় প্রতিদিনই ২০০ টাকার সাট্টা খেলেন। গত পাঁচ-ছ’বছরে এক বার ১০ হাজার টাকা জিতেছেন, এক বার পাঁচ হাজার। তাঁর কথায়, ‘‘বাড়িতে অশান্তিও হয়। কিন্তু অভ্যাসের মতো হয়ে গিয়েছে। সাট্টা খেলার জন্য বেশি ট্রিপও করি।’’
দমদম পুরসভার উপপ্রধান বরুণ নট্ট সাট্টা ব্যবসার রমরমার কথা মানতে না চাইলেও অনেকে যে লুকিয়েচুরিয়ে এই ব্যবসা চালানোর চেষ্টা করেন, তা মেনে নিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘রেললাইনের আশপাশে অনেকে সাট্টার ঠেক চালানোর চেষ্টা করেন। আমরা খবর পেলেই রেল পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে বন্ধ করে দিই। আবাসিক এলাকায় ওই ধরনের ব্যবসা তেমন সক্রিয় নয়। তবে আমরা সতর্ক থাকি। তেমন কিছু দেখলে পুলিশকে জানাই।’’ বিধাননগরের ডেপুটি মেয়র অনিতা মণ্ডলও বলেন, ‘‘অনেক ক্ষেত্রেই আড়ালে এমন অসামাজিক কাজকর্ম চলে। আমরা জানতে পারলে পুলিশকে জানাই। এ সব ঠেকাতে পুলিশের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।’’ উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক সুমিত গুপ্ত বলেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলব।’’