ফাইল চিত্র।
চলছিল সবই। কিন্তু কেমন যেন বিবর্ণ। প্রকাশ্যে চলা সেই দাদাগিরিটাই কোথাও যেন উধাও। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে দল বদলের বাজারে এমনই চেহারা নিয়েছিল রাজারহাট-নিউ টাউনের রমরমা সিন্ডিকেট ব্যবসা। তালা ঝোলানো থাকত জায়গায় জায়গায় গজিয়ে ওঠা সিন্ডিকেটের অফিসে। কয়েক মাসের জন্য কার্যত অদৃশ্যই হয়ে গিয়েছিল ওই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ‘নারায়ণী সেনা’! দাপুটে নেতা-দাদার দল বদল, না কি অন্য কোনও জটিল অঙ্ক এর জন্য দায়ী, তা নিয়েই জোর চর্চা শুরু হয়েছিল নির্বাচনের সময়ে।
ওই ব্যবসার সঙ্গে যুক্তদের অবশ্য দাবি, একসঙ্গে বেশ কয়েকটি ব্যাপার ঘটেছিল সেই সময়ে। জ্বালানির দাম খুব বেশি বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো মুনাফা রাখা সমস্যার হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। সেই সঙ্গে একাধিক অভিযোগে বিদ্ধ প্রশাসনও কড়াকড়ি শুরু করে খাদানগুলিতে। বেআইনি বালি-পাথর রফতানিতে কার্যত তালা পড়ে যায় ভোটের আগে। রাজারহাট-নিউ টাউনে সিন্ডিকেট-রাজ বন্ধ করতে প্রশাসনিক কড়াকড়িও শুরু হয়ে যায়। সর্বোপরি, করোনার প্রকোপে টানা লকডাউনে চলে যায় রাজ্য। ফলে গত বিধানসভা নির্বাচন ‘ঘর গোছানো’র পথ হয়ে দাঁড়ায় সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের জন্য। দীর্ঘ দিনের যে রমরমা ব্যবসা প্রকাশ্যে চলত, তা করতে গিয়ে বাধা পাওয়ায় তখন তাঁরা মরিয়া। কাকে সমর্থন দিলে ফের ফিরতে পারে ‘স্বর্ণযুগ’, সেই পরিকল্পনা করতেই তখন তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন।
তাতে অবশ্য সিন্ডিকেট ব্যবসায় পুরোপুরি তালা পড়ে যায়নি কখনওই। কম করে হলেও গাড়ি-পিছু প্রতি ১০০ ঘনফুটে বালি এবং পাথরের চড়া দাম হাঁকা চলতে থাকে। কোথাও চার হাজার টাকার সামগ্রীর জন্য দর হাঁকা হয় দু’-তিন হাজার টাকা বেশি। কোথাও আবার চাওয়া হয় তারও অতিরিক্ত। সেই সঙ্গে নির্মাণ সামগ্রী জলে ভিজিয়ে ওজন বাড়িয়ে বিক্রি করার পুরনো কায়দাও চলতে থাকে রমরমিয়ে। ওই এলাকায় কাজ করতে গিয়ে বাধ্য হয়ে এমন সামগ্রী কিনতে হয়েছিল এক প্রোমোটারকে। তিনি বললেন, ‘‘আমরা তো আর ঘর থেকে টাকা দেব না। শেষ পর্যন্ত ফ্ল্যাটের দাম বাড়ে। ক্রেতাকেই দিতে হয়। কিন্তু সামান্য কয়েক বছরের মধ্যেই দেওয়ালে নোনা ধরে যায়।’’
এর সঙ্গেই যুক্ত হয় আর এক নতুন ব্যবসা, যা ওই এলাকায় ‘মাটি সিন্ডিকেট’ নামে পরিচিত। স্থানীয় সূত্রের খবর, এই সিন্ডিকেট মূলত গড়ে ওঠে অ্যাকশন এরিয়া-২ এবং ৩-কে ঘিরে। জমিতে ভিত তৈরির জন্য মাটি কাটতে হয় এবং নির্মাণকাজের জন্য নিচু জমি ভরাট করতে মাটি ফেলতে হয়। হিডকো-নির্ধারিত জমি থেকে নির্মাণস্থল পরিষ্কারের নামে বিনা খরচে মাটি তুলে নিয়ে গিয়ে সেই মাটিই বহু টাকার বিনিময়ে ফেলা হয় অন্য নির্মাণস্থলে। নির্মাণ সামগ্রীর সঙ্গেই দর ওঠে মাটির। কোথাও মাটি কাটা বা ফেলার জন্য ১৫-২০ হাজার টাকা পর্যন্তও দর হাঁকা হয় বলে অভিযোগ। এক ব্যবসায়ী বললেন, ‘‘সিন্ডিকেট চালাতে খালের ধার থেকেও মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। যে কারণে খালগুলির জলধারণ ক্ষমতা কমছে। এ বার বাগজোলা খাল উপচে সাপুরজি এলাকা জলমগ্ন হওয়ার পিছনেও খালপাড়ের মাটি কাটা একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।’’
আর এক ঠিকাদারের কথায়, ‘‘মাটি কাটার পরে নির্মাণস্থল থেকে জমে থাকা মাটি সরানোর জন্যও মোটা টাকা চাওয়া হয়। সেই টাকা না দিলে নির্মাণস্থলে মাটি জমে থাকবে। পরিষ্কার হবে না। দাদারা নিজেদের মধ্যে এলাকা ভাগ করে রাখায় অন্য কেউ এসে সেই মাটি তুলবে না।’’
পুরনো নেতা-দাদার পরিবর্তে নতুন যিনি ক্ষমতা হাতে পান, প্রকাশ্যে না হলেও এ সবের পিছনে তাঁরও প্রচ্ছন্ন মদত ছিল বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। ফলে দাপট কমলেও নেতাদের দল বদল কখনওই সিন্ডিকেটের কারবার সম্পূর্ণ বন্ধ করতে পারেনি বলে দাবি তাঁদের। রাজারহাট-নিউ টাউনের বিধায়ক তাপস চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বললেন, ‘‘আমি বিধায়ক হওয়ার পরে জানিয়ে দিয়েছিলাম, এ সব একেবারে বরদাস্ত করা হবে না। পুলিশও কড়া হাতেই সবটা দেখছে।’’ রাজারহাট-নিউ টাউনের লোকজনের অবশ্য দাবি, বাস্তব চিত্র অন্য কথাই বলে। (চলবে)