সুচেতন ভট্টাচার্য ওরফে (অ্যালিয়াস) সুচেতনা ভট্টাচার্য। —নিজস্ব চিত্র।
রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কন্যা সুচেতনা ভট্টাচার্য লিঙ্গ পরিবর্তন করে ‘সুচেতন’ হতে চান। সেই মর্মে আইনি পরামর্শও নিতে শুরু করেছেন তিনি। প্রয়োজনীয় শংসাপত্রের জন্য যোগাযোগ করেছেন মনোবিদের সঙ্গেও।
সম্প্রতি একটি ‘এলজিবিটিকিউ’ কর্মশালায় অংশ নিয়েছিলেন সুচেতনা। সেই কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী একজন সমাজমাধ্যমে সুচেতনা সম্পর্কে একটি লম্বা পোস্ট করেছেন। ‘গৌরব মাসের গল্প’ শিরোনামের সেই পোস্ট শুরুই হয়েছে এটা লিখে যে, ‘সুচেতনা আজ থেকে সুচেতন’। সেই পোস্টেই জানানো হয়েছে, সুচেতনার বাবা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দীর্ঘ দিন ধরেই অসুস্থ। মা মীরা ভট্টাচার্যের পেসমেকার বসেছে।
বুধবার আনন্দবাজার অনলাইনকে সুচেতনা বলেছেন, ‘‘আমার পিতৃ-মাতৃ পরিচয় বা পারিবারিক পরিচয়টা বড় কথা নয়। আমি এটা করছি আমার এলজিবিটিকিউ+ আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে। একজন ট্রান্সম্যান হিসেবে প্রতি দিন আমায় যে সামাজিক হেনস্থা হতে হয়, সেটা আমি বন্ধ করতে চাই। আমি প্রাপ্তবয়স্ক। আমার বয়স এখন ৪১ প্লাস। ফলে আমি আমার জীবন সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারি। এই সিদ্ধান্তও সেই ভাবেই নিচ্ছি। দয়া করে আমার বাবা-মাকে এর মধ্যে টেনে আনবেন না। এখন নিজেকে যিনি মানসিক ভাবে পুরুষ মনে করেন, তিনিও পুরুষ। যেমন আমি। আমি নিজেকে মানসিক ভাবে পুরুষ বলেই মনে করি। আমি এখন সেটা শারীরিক ভাবেও হতে চাই।’’
সুচেতনা জানাচ্ছেন, বুদ্ধদেব তাঁর কন্যার ছোটবেলা থেকেই বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন। ফলে তিনি ধরে নিচ্ছেন, তাঁর বাবার এই সিদ্ধান্তে সমর্থনই থাকবে।
বস্তুত, সুচেতনার এই সিদ্ধান্তকে ‘সাহসী’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন সমাজের একটি অংশ। তাঁদের বক্তব্য, সুচেতনার মতো কেউ যদি এই সিদ্ধান্ত নেন, তা হলে এলজিবিটিকিউ+ আন্দোলন অনেক গতি পাবে। সুচেতনা নিজেও বলছেন, ‘‘আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ফলে আমি এটা নিয়ে লড়ে যাব। সেই সাহসটা আমার আছে। কে কী বললেন, তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। আমি সকলের সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিতে তৈরি।’’ অনেকেই বলছেন, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কন্যা হয়েও এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যে দৃঢ়সংকল্প দরকার, সুচেতনা তা দেখিয়েছেন। সেই জন্যই তিনি সমাজের অকুণ্ঠ সমর্থন পাবেন।
সুচেতনা (যদিও তিনি চান তাঁকে এখন ‘সুচেতন’ বলেই সম্বোধন করুন সকলে) নিজেও ওই কর্মশালা সম্পর্কে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। যাতে তিনি লিখেছেন, ‘‘পিআরসি-র ৮০তম প্রতিষ্ঠা বছর উদ্যাপন উপলক্ষে ১০ জুন, ২০২৩ অ্যাকশন টু হেল্থ অফ দ্য এলজিবিটিকিউ+কমিউনিটি ওয়ার্কশপে যোগদান করে আমি খুবই গর্বিত ও আনন্দিত। ওয়ার্কশপে প্রতিটি আলোচনার বিষয় সুচিন্তিত এবং প্রাসঙ্গিক। এলজিবিটিকিউ+ মানুষের অধিকার ও সমস্যা নিয়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম, যা আমার মতো ট্রান্সম্যানকে সমৃদ্ধ করেছে, উৎসাহ ও আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে।’’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘বিভিন্ন জেলা থেকে আসা এলজিবিটিকিউ+ মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেও খুব ভাল লেগেছে। তথাকথিত ‘মূলস্রোত’ সমাজের চোখরাঙানি, উপহাস, ঘৃণাকে মোকাবিলা করে এঁরা যে ভাবে লড়াই করছেন, এগিয়ে চলেছেন, তা আমার কাছে বিশেষ শিক্ষণীয়। পিআরসি-র উদ্যোক্তাদের এই প্রয়াসকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ এলজিবিটিকিউ+ বৃত্তের বাইরের সমাজসচেতন মানুষদেরও যাঁরা এই আন্দোলনের শরিক।’’
সুচেতনা তাঁর বিবৃতিটির নীচে লিখেছেন, ‘সুচেতন ভট্টাচার্য ওরফে (অ্যালিয়াস) সুচেতনা ভট্টাচার্য’। তার আগের অনুচ্ছেদে লিখেছেন, ‘‘এই ধরনের উদ্যোগ আরও বেশি করে হওয়া দরকার এবং এই ওয়ার্কশপগুলি থেকে যে পর্যবেক্ষণ উঠে আসছে, সেগুলোর সমাধান/প্রয়োগের দিকেও লক্ষ রাখা প্রয়োজন। লাগাতার আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই এলজিবিটিকিউ+ মানুষদের তাদের প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিতে তথাকথিত ‘মূলস্রোত’ সমাজকে বাধ্য করতে হবে।’’
তাঁর বিবৃতির কথা জেনে সুচেতনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। তিনি বলেছেন, ‘‘আমি সম্পূর্ণ সচেতন ভাবেই এই বিবৃতি দিয়েছি। সুচেতনা থেকে যাতে সুচেতন হতে পারি, সেই মর্মে আইনি পরামর্শও নিয়েছি এবং নিচ্ছি। আমি বহু দিন ধরেই এটা করতে চাইছিলাম। এখন সেই পদক্ষেপ করছি।’’
তিনি রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কন্যা হওয়ায় এই বিষয়টি নিয়ে যে ‘জলঘোলা’ হতে পারে, সে সম্পর্কেও সম্যক অবহিত সুচেতনা। কিন্তু তিনি সে সবের ভয় পাচ্ছেন না বলেই তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর। এমনকি, ঘনিষ্ঠমহলে সুচেতনা জানিয়েছেন, প্রয়োজন হলে তিনি ‘পদবিহীন’ হয়ে শুধু ‘সুচেতন’ও হয়ে যেতে পারেন। কারণ, সুচেতনার সঙ্গে ‘ভট্টাচার্য’ পদবি জুড়লেই বিতর্ক দেখা দেয়।
সুচেতনার ঘনিষ্ঠ সূত্রেও দাবি, বুদ্ধদেব তাঁর কন্যার এই ইচ্ছার বিষয়ে অবহিত এবং তাঁর এতে সমর্থনও রয়েছে। তবে তাঁর স্ত্রী মীরাদেবী বিষয়টি নিয়ে এখনও ততটা ‘স্বচ্ছন্দ’ হতে পারেননি। সুচেতনার এক ঘনিষ্ঠের কথায়, ‘‘উনি (মীরাদেবী) এখনও বিষয়টা নিয়ে ডিনায়ালে রয়েছেন। আগেও ছিলেন। কিন্তু সুচেতনা সেটা নিয়ে ভাবছেন না। উনি মনে করছেন, মূলস্রোতের সমাজকে যদি এলজিবিটিকিউ মানুষদের প্রাপ্য সম্মান দিতে বাধ্য করতে হয়, তা হলে এই পদক্ষেপ করা জরুরি।’’
সুচেতনার সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ফেসবুক পোস্টটিতে তাঁর ‘জীবনসাথী’র উল্লেখও রয়েছে। লেখা হয়েছে, ‘‘সুচেতন সুচন্দাকে পেয়েছে জীবনসাথী হিসেবে। একই সঙ্গে ঘর বেঁধেছে সুচেতন ও সুচন্দা। সুচেতন একটি অডিয়ো ভিস্যুয়ালে ফ্রি ল্যান্সিংয়ের কাজ করে আর সুচন্দা একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। শারীরিক লিঙ্গপরিচয় যা-ই হোক না কেন, ছোটবেলা থেকেই নিজেকে ছেলে মনে-করা সুচেতন পেয়েছে পারিবারিক প্রেরণা। তার বাবাই তাকে ছোটবেলায় গালে সাবান লাগিয়ে দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে দিতেন। তাই নিজের প্রবণতায় তার বেড়ে ওঠা হয়ে উঠেছে স্বচ্ছন্দেই। শরীরে, মনে, সামাজিক প্রকাশনায় ট্রান্সম্যান রূপেই পরিচিত হয়েছে সুচেতন।’’
এর পরেই লেখা হয়েছে, ‘‘কিন্তু সে এবার বৃহত্তর প্রেক্ষিতে তৃতীয় লিঙ্গের ও প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের সংগ্রামে অবতীর্ণ করতে চায় নিজেকে। আর সে দিনের পর থেকে নিজের ভিতর আটকে থাকা সুচেতন এখন অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠেছে। এলজিবিটিকিউআইএ+ কমিউনিটির মানুষদের জীবনযন্ত্রণা ও লড়াই, সংগ্রামের সাথে মিশতে চলেছে সুচেতনা। আমাদের লড়াইয়ে যুক্ত হল আরও এক যোদ্ধা। সার্থক হোক ওর সুচেতনা থেকে সুচেতন হওয়ার লড়াই। মৌলবাদ, পুঁজিবাদ ও ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে আমাদের মিলিত অগ্রগতিতে সার্থক হোক ওর অংশগ্রহণ। সবাই ওর পাশে থাকুন। আমাদের সাথে থাকুন।’’
সুচেতনা এই পোস্ট সম্পর্কে অবহিত। অবহিত তাঁর জীবনসাথীও। বুধবার সুচেতনা বলেন, ‘‘আমি পোস্টটা দেখেছি। এটা আমার একটা লড়াই। আমি শুধু এই লড়াই আমার জন্য লড়ছি না। লড়ছি আরও অনেক অনেক প্রান্তিক মানুষের জন্য।’’