ভরতপুরের বিধায়ক হুমায়ুন কবীর (বাঁ দিকে)। বলাগড়ের বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারী (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে টিকিট বিলি নিয়ে তৃণমূলের অন্তর্কলহ অব্যাহত। এ বার পঞ্চায়েত ভোটে প্রার্থী ঘোষণা নিয়ে সরাসরি দলকে কাঠগড়ায় তুলেছেন দুই বিধায়ক। এক জন মুর্শিদাবাদের ভরতপুরের বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী হুমায়ুন কবীর। অন্য জন হুগলির বলাগড়ের বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারী। হুমায়ুন সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। মনোরঞ্জন অবশ্য স্পষ্ট করে ক্ষোভের কারণ বলেননি। তবে দলের দুটি পদ ছাড়ার কথা ঘোষণা করেছেন সমাজমাধ্যমে। জানিয়েছেন, পরে বিধায়ক পদ থেকেও সরে যাবেন। পঞ্চায়েত ভোটের আবহে ‘বিদ্রোহী’ বিধায়কদের নিয়ে শোরগোল শুরু হয়েছে তৃণমূলের অন্দরে। তাঁদের নিয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব কী বলছেন? তাঁরা কি বিধায়কদের কথায় গুরুত্ব দিচ্ছেন আদৌ? দুই বিধায়কের বার্তা নিয়েই বা কী ভাবছে তৃণমূল?
পঞ্চায়েত ভোটে টিকিট বিলি নিয়ে ভরতপুরের বিধায়ক হুমায়ুন সরাসরি জেলার সাংগঠনিক সভাপতি শাওনি সিংহ রায়কে অপসারণের দাবি করেছেন। অন্যথায় তিনি বিধায়ক পদ ছাড়বেন এবং বহরমপুরের দলীয় কার্যালয় ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। প্রয়োজনে ইসলামপুরের বিধায়ক আব্দুল করিম চৌধুরীর পথে হাঁটার কথাও বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বিধায়ক আব্দুল করিম চৌধুরী মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানিয়েছেন যাতে প্রশাসন নিরপেক্ষ আচরণ করে। আমিও মুখ্যমন্ত্রীকে বলছি, আপনার প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকুক। না হলে জেলায় নির্দলদের হয়ে প্রচার করব। দেখব কার কত শক্তি!”
গত বৃহস্পতিবার মুর্শিদাবাদ জেলার আরও তিন তৃণমূল বিধায়ক— রেজিনগরের রবিউল আলম চৌধুরী, নওদার শাহিনা মমতাজ এবং জলঙ্গির আব্দুর রজ্জাককে সঙ্গে নিয়ে বেলডাঙার দলীয় কার্যালয়ে বসে ‘তোলাবাজদের টিকিট দেওয়া হচ্ছে’ বলে অভিযোগ তুলেছিলেন হুমায়ুন। চার বিক্ষুব্ধ বিধায়কের নিশানায় ছিলেন, মুর্শিদাবাদ-বহরমপুর সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান তথা কান্দির বিধায়ক অপূর্ব (ডেভিড) সরকার এবং দলের জেলা সভাপতি শাওনি সিংহ রায়।
হুমায়ুনের হুমকি নিয়ে বহরমপুর সাংগঠনিক জেলার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অপূর্ব সরকারের বক্তব্য, ‘‘কে কোথায় কী বলছেন, সে নিয়ে আমরা ভাবিত নই। আমরা পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত আছি। মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার ভাল চোখে দেখছি না।’’
কিন্তু ভোটের মুখে দাপুটে বিধায়কের এই মন্তব্য অস্বস্তি বাড়িয়েছে শাসকদলের। তার মধ্যেই বুধবার সামনে এসেছে বলাগড়ের বিধায়ক মনোরঞ্জনের বয়ান। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে দলিত সাহিত্যিককে প্রার্থী করেছিলেন মমতা। সেই মনোরঞ্জন পঞ্চায়েত ভোটের আগে ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন হুগলি জেলার (জোনাল-৬) পঞ্চায়েত নির্বাচন কমিটির সদস্যপদ এবং রাজ্য তৃণমূল কমিটির সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দিচ্ছেন। মনোরঞ্জন জানাচ্ছেন, ব্যক্তিগত কারণেই এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু কিছু দিন আগে বিধায়কের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে পঞ্চায়েত ভোটে টিকিট বিলির অভিযোগ করেন তাঁর দলেরই এক ব্লক স্তরের নেতা। তাই নিয়ে পাল্টা তাঁকে আক্রমণ করেন মনোরঞ্জন। সেই নিয়ে তিনি ফেসবুকে লিখেছেনও। বুধবার তৃণমূল বিধায়ক লেখেন, ‘‘বিধায়ক পদ থেকেও ইস্তফা দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু যে হেতু আগে আমি একটি চাকরি করতাম, নির্বাচনে লড়ার জন্য সেটি ছাড়তে হয়েছিল। দু’বছরের অধিক সময় হয়ে গেল পঞ্চাশ বার ছোটাছুটি করেও যার পেনশন এবং গ্রাচুইটির কিছু পাইনি। তাই এই মুহূর্তে বিধায়ক পদ ছাড়তে পারছি না।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘এত দিনে বুঝতে পেরেছি এই রাজনীতি আমার মতো মানুষের জন্য নয়।’’
মনোরঞ্জন আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘বিজেপি-সিপিএম সবার সঙ্গে লড়াই করব। কিন্তু নিজের দলের লোকের সঙ্গে আর লড়াই করতে চাই না। মগরা ব্লকে আমাকে একটিও টিকিট দেওয়া হয়নি, অনেক লড়াই করে হোয়েড়া দিগসুইয়ে কয়েক’টা আসন বার করতে পেরেছি। চন্দ্রহাটি, মগরায় কয়েক’টি আসন পেয়েছি। যেন মনে হচ্ছে, ভিক্ষা দিচ্ছে। অনেকবার উচ্চ নেতৃত্ব কে জানিও কিছু হয়নি। আমাদের শুধু সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে। দলীয় নেতৃত্ব এর সঙ্গে সম্পূর্ণ যুক্ত রয়েছেন। আমি দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। তার কাছে ৫ মিনিট সময় চেয়েছিলাম। আমাকে সেই সময়ও দেওয়া হয়নি।’’
এই দুটি ঘটনা প্রসঙ্গে তৃণমূলের মুখপাত্র তথা বিধায়ক তাপস রায় আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘প্রত্যেক বিধায়কই চান তাঁর এলাকায় পছন্দের প্রার্থী হোক। কিন্তু দল যখন কোনও আসনে প্রার্থীকে মনোনীত করে তখন সার্বিক ভাবে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেই সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে এই বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ হতেই পারে। আশা করছি, দলীয় শীর্ষ নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে দুই বিধায়কের ক্ষোভ প্রশমিত হবে।’’ যদিও শীর্ষ নেতৃত্ব এ নিয়ে ইতিমধ্যে কোনও পদক্ষেপ করছেন কি না, তা এখনও জানা যায়নি। তবে তৃণমূল মুখপত্র শান্তনু সেন বলেন, ‘‘মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে ভোট দেয়। তার বাইরে কে কি বলল তা নিয়ে তৃণমূল খুব একটা চিন্তিত নয়।’’