তাঁরা কেউই বিশেষণে ভূষিত নন। প্রত্যেকেই সর্বনাম। এ শহরের রাজপথে, অলিগলিতে অগুনতি মানুষের ভিড়ে মিশে থাকা এক-একটি মুখ।
kolkata municipal corporation

দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চলে ভিন্ রাজ্যের মহম্মদদের

‘‘৩০ বছর ধরে এখানেই বসছি। দুপুর ২টো থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত।’’— বলছিলেন মহম্মদ।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২১ ০৫:৪০
Share:

উদ্যোগী: কলকাতা পুর ভবন সংলগ্ন রাস্তায় মহম্মদের ব্যবসা। নিজস্ব চিত্র

দূর থেকে ঘণ্টার আওয়াজটা শোনা যাচ্ছিল। তবে একটানা নয়, থেমে থেমে। আওয়াজের উৎস খুঁজতে গিয়ে কলকাতা পুর ভবনের ঠিক বিপরীত রাস্তায় পাওয়া গেল মহম্মদকে। সামনে ওজন মাপার একটি যন্ত্র। এ ভাবেই ঘণ্টা বাজিয়ে মহম্মদ জানান দেন, নামমাত্র টাকায় ওজন মাপা হয়।

Advertisement

নিউ মার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা জনতা, পথচারীদের কেউ কেউ ওজন মাপিয়ে নেন। মহম্মদের কাছে জানতে চান, ‘‘ওজন ঠিক আছে তো?’’ মহম্মদ পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘‘আপনার হাইট কী আছে?’’ ওজন-মাপানো ব্যক্তি নিজের উচ্চতা বলতে পারলে মহম্মদও বলে দেন, ওজন ঠিক আছে কি না।

‘‘৩০ বছর ধরে এখানেই বসছি। দুপুর ২টো থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত।’’— বলছিলেন মহম্মদ। জানালেন, পার্ক সার্কাসে প্রথম এক জনকে ঘণ্টা বাজিয়ে ওজন মাপতে দেখে এই ভাবে রোজগার করার কথা মাথায় এসেছিল। তার পর থেকে পুর ভবন সংলগ্ন এলাকাতেই রোজ বসেন।
শহরের ফুটপাতে, রাস্তার ধারে অনেকের কাছে ওজনের পাশাপাশি আবার উচ্চতা মাপার ব্যবস্থা, রক্তচাপ মাপার যন্ত্র, সুগার পরীক্ষার মতো সুবিধাও রয়েছে। মহম্মদের কথায়, ‘‘আমিও ভাবছি ওই রকম কিছু করব। তা হলে বাড়িতে আরও বেশি টাকা পাঠাতে পারব।’’

Advertisement

বাড়ি কোথায়?

মহম্মদ জানালেন, তাঁর বাড়ি বিহারে। ভোটার কার্ডও সেখানকার। বাড়িতে আছেন বৌ, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। ছোট আকারেই হোক বা বড়, ভিন্ রাজ্য থেকে আসা মহম্মদেরা এ শহরে এসে আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধ করে নিজের জমি তৈরি করেন। সেখানে এখানকার ‘ভূমিপুত্র’দের একটা বড় অংশ এখনও চাকরিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। যা ব্যবসায়িক বৃত্ত থেকে ক্রমশ বাঙালিকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে। তাঁদের আক্ষেপ, বাঙালি অন্যের কাছে হাত পাতবে, তবু ব্যবসা করবে না— এ এক অদ্ভুত মানসিকতা!

‘‘শ্যামবাজার, হাতিবাগানে এখনও অনেক বাঙালি ব্যবসায়ী রয়েছেন ঠিকই। কিন্তু আস্তে আস্তে ছোট দোকানের বাঙালি মালিকেরা ব্যবসায় মন্দার কারণে দোকান বিক্রি করে দিচ্ছেন’’— বলছিলেন ‘হাতিবাগান বাজার মার্চেন্টস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রেসিডেন্ট রঞ্জন রায়। গড়িয়াহাটের আর এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘পরবর্তী প্রজন্ম আর পূর্বপুরুষের ব্যবসায় আসতে চাইছে না। তারা চাকরির সুযোগ খুঁজছে।’’ এর কারণ ব্যাখ্যা করে অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার জানাচ্ছেন, ঝুঁকি নিতে বাঙালি পছন্দ করে না। আর ছোট ব্যবসা বাঙালিরা করে শুধুমাত্র অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। বরং এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিই সরকারি চাকরিকে জীবনের সব চেয়ে বড় ‘অ্যাচিভমেন্ট’ বলে মনে করে। অভিরূপবাবুর কথায়, ‘‘আমাদের দুর্দশার বড় কারণ হল, স্থানীয় উদ্যোগপতিদের অভাব।’’

মারোয়াড়ি, গুজরাতি, পঞ্জাবিদের তুলনায় ব্যবসা করার প্রবণতা বাঙালিদের অনেকটাই কম। তবে বাঙালি এখনও সগর্বে ব্যবসা করছেন, সংখ্যায় কম হলেও এমন উদাহরণ রয়েছে বলে জানাচ্ছেন মানবসম্পদ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ বীর্যেন্দু গুপ্ত। তাঁর কথায়, ‘‘তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে সাধারণ বাঙালির ঝুঁকি নেওয়ার খিদে, ক্রেতার মন বুঝে চলার মানসিকতা তুলনামূলক ভাবে কম।’’ সমাজতাত্ত্বিক রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘বাঙালিদের ব্যবসা করার অনীহা রয়েছে, সেটা তথ্যগত ভাবে ঠিক নয়। তবে বড় ব্যবসার ক্ষেত্রে যেমন অবাঙালিদের প্রাধান্য বেশি ছিল, এ বার সেই প্রবণতা ছোট ব্যবসার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে।’’

বছর ছয়েক আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তেলেভাজা, মিষ্টির দোকান, কাপড়ের দোকান, চায়ের দোকানের মাধ্যমেও যে আর্থিক ভাবে শক্তিশালী হওয়া যায়, সে কথা বলেছিলেন। যা নিয়ে তখন তুমুল বিতর্ক হয়েছিল। তৃণমূল নেত্রী সে সময়ে বলেছিলেন, ‘‘আমার পাড়ায় কয়েকটি তেলেভাজার দোকান আমি চিনি, যাঁরা তেলেভাজা বিক্রি করে চার-পাঁচ-দশতলা বাড়ি করেছেন।’’ এক অর্থনীতিবিদের কথায়, ‘‘ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কথা ভেবে মুখ্যমন্ত্রী ওই কথা বলেছিলেন। কিন্তু এখন অন্য ব্যবসার মতো তেলেভাজার দোকানেও বাঙালি কোণঠাসা। ফলে যেখানে ছোট বাঙালি ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে দোকান বন্ধ করে দিচ্ছেন, সেখানে ভিন্ রাজ্য থেকে আসা মানুষেরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিজেদের বাড়ি পাকা করেন, কেউ কেউ দোতলাও করেন।’’

আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে যেমন মহম্মদ বলছিলেন, ‘‘এখান থেকে টাকা পাঠিয়ে বিহারের বাড়িটা পাকা করেছি।’’ জানালেন, খাবার বলতে হোটেলে গিয়ে দুপুরে তরকারি-ভাত আর রাতে রুটি-তরকারি। রাতে ফুটপাতেই চাদর-বালিশ পেতে শুয়ে পড়েন।

আসলে মহম্মদ জানেন, দেশের মধ্যে সব চেয়ে সস্তায় খাবার বোধহয় এখনও এই শহরেই পাওয়া যায়। মহম্মদ এ-ও জানেন, একটু কষ্ট করতে পারলে, একটু দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করতে পারলে এ শহর কখনও কাউকে খালি হাতে ফেরায় না। ফেরায়নি কখনও!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement