অবহেলা: কালো জলেই ডুবছে টালি নালার ভবিষ্যৎ। বুধবার, কালীঘাটের কাছে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক নিজস্ব চিত্র
উইলিয়াম টলি খাল সংস্কারের কাজ শুরু করেছিলেন প্রায় আড়াইশো বছর আগে। উদ্দেশ্য ছিল, পণ্য পরিবহণের উপযোগী জলপথ তৈরি করা। মজে যাওয়া খালকে সংস্কার করে নৌকা চলাচলের উপযোগীও করেছিলেন টলি। কিন্তু এত বছর পরে এসে দেখা যাচ্ছে, টালি নালা নামে খ্যাত সেই খালে নৌকা চলে ঠিকই। তবে তা আবর্জনা-নোংরা পরিষ্কারের জন্য!
জন্মসূত্রে যা ছিল পণ্য পরিবহণের জন্য তৈরি করা খাল (নেভিগেশন ক্যানাল), সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে সেটাই পরিণত হয়েছে তরল নিকাশি বর্জ্যের খালে (ওয়েস্ট ওয়াটার ক্যানাল)। তার এই অবনমনের জন্য শুধু যে নগরায়ণই দায়ী, তা নয়। এর পিছনে রয়েছে প্রশাসনিক উদাসীনতা এবং পরিকল্পনার অভাব। এমনটাই মনে করছে পরিবেশবিদ মহল। যে কারণে সংশ্লিষ্ট খাল বা টালি নালাকে এক সময়ে বলা হয়েছিল— ‘এটি একটি ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মলমূত্র পরিশোধক’!
আর এই ‘মলমূত্র পরিশোধক’ সংস্কারে বছরের পর বছর গিয়েছে, একের পর এক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু টালি নালার অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। পরিবেশবিদদের একাংশের মতে, টালি নালার সংস্কার হিসেবে যেটুকু রাজ্য প্রশাসনের তরফে দাবি করা হয়, তা যৎকিঞ্চিৎ। নৌকা চালিয়ে বা জলে ভাসমান বর্জ্য সরিয়ে টালি নালাকে কখনওই ‘সারফেস ওয়াটার-২’ ক্যাটেগরিভুক্ত জলাশয়ে (যেখানে স্নান, ওয়াটার স্পোর্টস বা বাণিজ্যিক ভাবে মাছ ধরা যেতে পারে) উন্নীত করা সম্ভব নয়।
কলকাতা-গবেষকদের একাংশ জানাচ্ছেন, টালি নালার সূত্রপাত হয়েছিল অসম, পূর্ববঙ্গের জেলা, তৎকালীন ২৪ পরগনা ও সুন্দরবন থেকে খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্য খিদিরপুরে আনার ব্যবস্থা করার জন্য। অবশ্য তারও আগে টালি নালার একটি প্রাক-ইতিহাস রয়েছে। এক সময়ে গোবিন্দপুর সাঁকোর তলা থেকে একটি খাল বয়ে যেত। সেই খালের নাম ছিল গোবিন্দপুরের খাল। এক কলকাতা গবেষকের কথায়, ‘‘ওই মজে যাওয়া খালের ইজারা পেয়েছিলেন শারমন সাহেব। তিনি নিজের খরচে খাল সংস্কার করে টোল আদায় করা শুরু করেছিলেন ১৭৫৮ সাল নাগাদ। তখন ওই খালের নাম ছিল শারমন খাল। পরে পলি পড়ে এ খালও বুজে যায়।’’
কলকাতা-গবেষক হরিপদ ভৌমিক জানাচ্ছেন, পরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্তা উইলিয়াম টলি তৎকালীন সরকারকে প্রস্তাব দেন, তিনি সম্পূর্ণ মজে যাওয়া আদিগঙ্গাকে নিজের খরচে কাটিয়ে অসম, পূর্ববঙ্গের জেলা-সহ অন্য জায়গা থেকে বিভিন্ন পণ্য খিদিরপুরে আনার ব্যবস্থা করবেন। সেইমতো টলি সাহেব জমির ইজারা, টোল আদায় ও খালের ধারে একটি বাজার বা গঞ্জ বসানোর জন্য সরকারের থেকে অনুমতি পেয়েছিলেন। ১৭৭২-’৮০ সালের মধ্যে সেই খাল সংস্কার ও তাতে নৌকা চলা শুরু হয় বলে হরিপদবাবু জানাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘হেস্টিংস থেকে শামুকপোতা পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার লম্বা খাল ততদিনে টালি নালা হিসেবে পরিচিত হয়ে গিয়েছে। এর পরে আরও গভীর ও চওড়া হয় টালি নালা।’’
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই চওড়া নালাও ক্রমাগত বুজে আসতে থাকে। যার আভাস বহু আগেই ধরা পড়েছিল বলে জানাচ্ছেন পরিবেশবিদেরা। তাই ১৯৯৫ সালে ‘এনভায়রনমেন্টাল প্রবলেমস ইন ক্যালকাটা মেট্রোপলিটন মিউনিসিপ্যালিটিজ়’ রিপোর্টে বলা হয়েছিল, কলকাতার যত আবর্জনা-বর্জ্য রয়েছে, টালি নালা তা বহন করে অন্য পুর এলাকায় নিয়ে যায়। রিপোর্টের কথায়,—‘টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়া পর্যন্ত বিস্তৃত টালি নালার জল তরঙ্গহীন, দুর্গন্ধযুক্ত এবং দুই পাড়েই ঝুপড়ি রয়েছে।’
রাজ্য প্রশাসনের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্তা জানাচ্ছেন, যে সময়ে টালি নালা সম্পর্কে ওই কথাগুলি বলা হয়েছিল, তখন টালি নালা আলোচনার বৃত্তে ছিল। হয়তো সে কারণেই ১৯৯৭ সালের ‘ক্যালকাটা এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট স্ট্র্যাটেজি অ্যাকশন প্ল্যান’ রিপোর্টে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি, খাল ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে টালি নালার সংস্কারের উপরেও জোর দেওয়া হয়েছিল। সে বছরেরই ডিসেম্বরে তৎকালীন রাজ্য সরকারের নগরোন্নয়ন দফতর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে বলেছিল, হেস্টিংস থেকে গড়িয়া পর্যন্ত ১৫.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ টালি নালার সংস্কার করে তা চলাচলের যোগ্য করা হবে।
তার ২৩ বছর পরে সেই রিপোর্টের কথা ‘সত্যি’ হয়েছে বটে! এখন টালি নালায় নৌকা চলাচল করে ঠিকই, তবে তা আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য! যে কারণে হরিপদবাবু বলছেন, ‘‘টালি নালার সংস্কারে আরও এক জন উইলিয়াম টলিকে চাই। অর্থাৎ এই কাজের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্যের তরফে উইলিয়াম টলির মতো প্রশাসনিক উদ্যোগের প্রয়োজন। না হলে আবর্জনার শাপমুক্তি ঘটবে না টালি নালার।’’
(চলবে)