ফাইল চিত্র।
প্রায় এক যুগ ধরে চলেছে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ। তাতে ছাত্ররা আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেই শিক্ষা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এ বার এসএসকেএম হাসপাতালের ‘স্কুল অব ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড লিভার ডিজ়িজ়’-এর (এসডিএলডি) চিকিৎসকেরা নিজেরাই যকৃৎ প্রতিস্থাপন করলেন। এ বার আর দিল্লি থেকে প্রশিক্ষকদের উড়ে আসতে হয়নি। গত ৮ ডিসেম্বর পিজিতে ব্রেন ডেথ হওয়া এক ব্যক্তির যকৃৎ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ৫৮ বছরের স্বপন বৈদ্যের শরীরে।
২০০৯ সালে পূর্ব ভারতের একমাত্র সরকারি হাসপাতাল পিজির এসডিএলডি-তে বিনা খরচে আট মাসের শিশু রোশন আলির লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়। সেই কথা আজও মনে রয়েছে হাসপাতালের হেপাটোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরীর। তিনি বলেন, ‘‘ওই শিশুকে বাঁচাতে গেলে লিভার বদলের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা মিলবে কোথায়? ব্রেন ডেথের পরে অঙ্গদান তখনও সে ভাবে প্রচলিত নয়। শেষে শিশুটির বাবাকেই বুঝিয়ে রাজি করানো হয়।’’ বর্ধমানের বাসিন্দা রোশনের বাবা, পেশায় রাজমিস্ত্রি রজব আলি ছেলেকে লিভারের অংশ দিতে পারবেন বলে জানিয়ে ছিলেন চিকিৎসকেরা।
কিন্তু প্রতিস্থাপনের দক্ষ চিকিৎসক কোথায়? সতীর্থের থেকে বিষয়টি জানতে পেরে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন দিল্লির বেসরকারি হাসপাতালের যকৃৎ প্রতিস্থাপনের শল্য চিকিৎসক সুভাষ গুপ্ত। কলকাতায় এসে পিজি-র এসডিএলডি-র শল্য চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়ে রজবের লিভারের অংশ প্রতিস্থাপন করেছিলেন রোশনের শরীরে। বছর খানেক আগে রোশনের মৃত্যু হয়েছে। সূত্রের খবর, ২০১১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ‘লাইভ’ প্রতিস্থাপনের (জীবিত দাতার লিভারের অংশ নিয়ে অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপন করা) প্রক্রিয়া জারি ছিল পিজিতে। এর মধ্যে ২০১০ সালে প্রথম ‘ক্যাডাভার ট্রান্সপ্লান্ট’ (মৃতের লিভার অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপন করা) হয় পিজিতে। ব্রেন ডেথ হওয়া এক রোগীর লিভার প্রতিস্থাপন করা হয় জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায় নামে এক রোগীর শরীরে। তিনিও পরে মারা যান।
রোশনকে দিয়েই শুরু হয়েছিল লিভার প্রতিস্থাপনে দিল্লি-কলকাতার মেলবন্ধন। পিজির গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক গোপালকৃষ্ণ ঢালি বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত যত লিভার প্রতিস্থাপন পিজিতে হয়েছে, প্রতি ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র একটা ফোন গিয়েছে দিল্লিতে সুভাষবাবুর কাছে। কখনও তিনি নিজে, কখনও আবার তাঁর দলের কোনও চিকিৎসক চলে এসেছেন পিজিতে।’’ লিভার প্রতিস্থাপনে কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে। সেই সময়ে একেবারে হাতেকলমে পিজির চিকিৎসকদের শেখাতেন সুভাষবাবুরা।
সুভাষবাবু বলেন, ‘‘সকলের মধ্যে একটা ধারণা ছিল, লিভার প্রতিস্থাপন সরকারি হাসপাতালে হয় না। এর জন্য বেসরকারি ক্ষেত্রে প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়। আবার অনেকে মনে করতেন, এই অস্ত্রোপচার বিদেশেই সম্ভব। কিন্তু আমি ভাবতাম, দেশে সরকারি স্তরে কেন হবে না? তাই পিজিতে রোশনের বিষয়টি শুনেই আর দেরি করিনি, চলে এসেছিলাম। আসানসোলের ছেলে হিসেবে মনে হয়েছিল, আমার রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে বিনা খরচে লিভার প্রতিস্থাপন হোক।’’ ২০০৯ থেকে ২০২১— দীর্ঘ ১২ বছরে পিজিতে ‘লাইভ’ এবং ‘ক্যাডাভার ট্রান্সপ্লান্ট’ মিলিয়ে মোট ২৭টি প্রতিস্থাপন হয়েছে।
গোপালকৃষ্ণবাবু বলেন, ‘‘২৭টির মধ্যে এক তৃতীয়াংশ ব্যর্থ হলেও বাকিরা জীবিত আছেন।’’ আর এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিনা মূল্যে এসেছেন সুভাষবাবু বা তাঁর দলের আর এক চিকিৎসক তথা কলকাতার বাসিন্দা রাজেশ দে কিংবা অন্য কেউ। শুরুর দিকে লিভার প্রতিস্থাপন ঝুঁকিপূর্ণ থাকলেও এখন গোটা প্রক্রিয়াটি অনেক সরলীকরণ হয়েছে বলেই জানাচ্ছেন সুভাষবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘আগে এই অস্ত্রোপচারে অনেক সমস্যা হত। কিন্তু এখন প্রতিস্থাপনের আগে রোগীর অনেক কিছু আগাম জেনে সেই মতো ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’’ সুভাষবাবুদের সহযোগিতায় পিজির লিভার প্রতিস্থাপনের শল্য চিকিৎসকেরা বিদেশে গিয়েও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তবে ২০১২ থেকে ’১৪ সাল পর্যন্ত কোনও প্রতিস্থাপন হয়নি।
আজ, বৃহস্পতিবার পিজি থেকে ছাড়া পাবেন স্বপনবাবু। এই প্রথম কারও সহযোগিতা ছাড়াই তাঁর ছাত্রদের অস্ত্রোপচারের সাফল্যের ঘরোয়া অনুষ্ঠানে দিল্লি থেকে উড়ে আসবেন শিক্ষক সুভাষবাবুও।