উদ্যাপন: কবির জন্ম শতবর্ষে তালতলার সেই বাড়িতে বসানো হয়েছিল ফলক। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
শেষ ডিসেম্বরের কনকনে শীতের রাত। তালতলা লেনের শুনশান গলিটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। একটি আটপৌরে বাড়ির একতলার ভাড়ার ঘরে শুধু টিমটিমে আলোর আভাস। দু’জন বাসিন্দার এক জন সেখানেও ঘুমিয়ে কাদা। জেগে আছেন ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মেঘবর্ণ দোহারা তরুণ। কেমন ভূততাড়িতের মতো কী যেন লিখে চলেছেন।
সে ছিল একশো বছর আগের কলকাতা। ১৯২১-এর শেষ দিকের কথা। সদ্য লেখা সেই কবিতা ছাপার অক্ষরে জন্মের আলো দেখে ১৯২২-এর জানুয়ারিতে, সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায়। কবিতার নাম ‘বিদ্রোহী’! কাজী নজরুল ইসলামের ছোট বৌমা, প্রবীণ সঙ্গীতশিল্পী কল্যাণী কাজী বলছিলেন, এই কবিতাটা উনি পেনসিলে লিখেছিলেন। কারণ, নজরুলের কাছে ফাউন্টেন পেন ছিল না। ‘‘শুনেছি, ওঁর মনে হয়েছিল, দোয়াতে বার বার কলম ডুবিয়ে লিখতে গেলে কবিতার ছন্দ টাল খাবে, তাল কেটে যাবে! তাই পেনসিলে খসখস করেই নাগাড়ে লিখে দীর্ঘ কবিতাটা শেষ করেন।’’
নজরুল তখন মাত্র ২২ বছরের তরুণ। সাধারণ বদ্ধ জীবনের সংস্কার-ভাঙা ঝোড়ো যুবকের হাতে ও বোধে সৃষ্টি হচ্ছে, গত শতকে অন্যতম সর্বাধিক চর্চিত একটি কবিতা। পরাধীন দেশের এক তরুণ ছন্দের নেশায় মাতাল হয়ে একাধারে শিবের জটা, ইস্ত্রাফিলের শিঙা বা শ্যামের বাঁশি হয়ে উঠছেন অবলীলায়। লিখছেন, ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির’ কিংবা ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন’!
বাংলা ভাষায় লেখা এমন একটি কবিতা, যার লাইন এখনও মুখে মুখে ফেরে। কবিতার নামে কবির নামও হয়ে যায় ‘বিদ্রোহী’! এ কবিতার জন্ম-কাহিনি নিয়ে পরে বিশদে লিখেছেন এ দেশে কমিউনিস্ট পার্টির আদি যুগের পুরোধা ‘কাকাবাবু’ মুজফফর আহমেদ। ৩/৪সি, তালতলা লেনের ভাড়ার ঘরে তখন তিনিই নজরুলের সঙ্গী।
‘তখন নজরুল আর আমি নীচের তলায় পুব দিকের, অর্থাৎ বাড়ির নীচেকার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটি নিয়ে থাকি। এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি
লিখেছিল। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রে। রাত্রির কোন সময়ে তা আমি জানিনে। রাত দশটার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি, এমন সময়ে নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে আমায় পড়ে শোনাল। বিদ্রোহী কবিতাটির আমিই প্রথম শ্রোতা।’, ‘কাজী নজরুল ইসলাম— স্মৃতিকথা’ বইয়ে লিখেছেন কাকাবাবু।
তালতলার বাড়িটায় ১৯৯৯-এ নজরুল শতবর্ষে একটি ফলক বসেছে। ২০১১-য় ‘বিদ্রোহী’র ৯০ বছর পূর্তিতে একটি রৌপ্যমুদ্রা স্মারক প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকার। অতিমারির এই আবহেও ‘বিদ্রোহী’কে বাঙালি ভোলেনি, বলছিলেন নজরুলের নাতি কাজী অনির্বাণ। তাঁর কথায়, “বাংলাদেশ, মেক্সিকো, নিউ জার্সিতেও অনলাইন অনুষ্ঠান হয়েছে। আমার বোন অনিন্দিতা কাজী নিউ জার্সিতে বসে অনুষ্ঠান করেছে।’’
নজরুলের এই কবিতার সৌজন্যেই তাঁর বড় ছেলে, আবৃত্তিশিল্পী কাজী সব্যসাচীকেও মনে পড়ছে অনেকের। যাঁর কণ্ঠে অমোঘ পংক্তিগুলো শুনলে আজও গায়ে কাঁটা দেয় কত জনের। ‘তালতলা নজরুল জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন কমিটি’র মুখ্য সমন্বয়কারী তথা চিকিৎসক শঙ্কর নাথ, সুকান্ত মুখোপাধ্যায়রাও সমাজমাধ্যমে নজরুলের এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার উপরে আলোচনাসভা বসিয়েছেন। কাকাবাবুর লেখায় জানা যায়, তখন ‘বিদ্রোহী’র জন্যই বিজলী পত্রিকার সংখ্যাটি নতুন করে ছাপতে হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’, বঙ্গভঙ্গের সময়কার বিভিন্ন রবীন্দ্রগান বা শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবি’র মতোই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মননেও গভীর ছাপ ফেলে ‘বিদ্রোহী’।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শামসুর রাহমানও লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা’! সুকান্তবাবুদের কথায়, ‘‘এ কবিতার নানা দিক নিয়ে আরও গভীরে আলোচনা দরকার। এ যুগের শাসকদের পক্ষেও বোধহয় নজরুলের বিদ্রোহী’কে হজম করা খুব সোজা কাজ নয়।’’