বরো-১৪

তাঁর চোখে সকলই শোভন, তবু মন্দ বলেন নিন্দুকেরা

রাস্তার ডান-বাম দু’দিকেই ১০ গজ অন্তর ফ্লেক্স। পেল্লাই সাইজের। তাতে প্রার্থীর আপাদমস্তক দণ্ডায়মান ছবি। করজোড়ে, হাসিমুখে। আর ওই ১০ গজের মধ্যেই আবার ওই প্রার্থীর অজস্র ব্যানার, দলীয় পতাকা। যে রাস্তার দু’পাশে বাহারি প্রচার, সেই রাস্তাও ঝকঝকে। প্রচারের ওই ‘সাজগোজ’ ধরে এগোতে এগোতেই এসে পড়ল প্রার্থীর বাড়ি। ৩৬ নম্বর মহারানি ইন্দিরা দেবী রোড। বাড়ির নাম গোপাল ভবন। প্রবেশদ্বারে রবিঠাকুরের মূর্তি বসানো।

Advertisement

অনুপ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৫ ০১:১৫
Share:

রাস্তার ডান-বাম দু’দিকেই ১০ গজ অন্তর ফ্লেক্স। পেল্লাই সাইজের। তাতে প্রার্থীর আপাদমস্তক দণ্ডায়মান ছবি। করজোড়ে, হাসিমুখে। আর ওই ১০ গজের মধ্যেই আবার ওই প্রার্থীর অজস্র ব্যানার, দলীয় পতাকা। যে রাস্তার দু’পাশে বাহারি প্রচার, সেই রাস্তাও ঝকঝকে। প্রচারের ওই ‘সাজগোজ’ ধরে এগোতে এগোতেই এসে পড়ল প্রার্থীর বাড়ি। ৩৬ নম্বর মহারানি ইন্দিরা দেবী রোড। বাড়ির নাম গোপাল ভবন। প্রবেশদ্বারে রবিঠাকুরের মূর্তি বসানো।

Advertisement

জায়গাটা বেহালার পর্ণশ্রী। আর অন্তঃপুরের বাসিন্দা কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। এ বারও যিনি কলকাতা পুরসভার ১৩১ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী। বাড়ির পাশেই ডজন খানেক গাড়ি। দু’টি প্রচারের জন্য সাজানো। যে দিকে নজর যায়, সর্বত্রই ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশীর্বাদধন্য মেয়র পদপ্রার্থী শোভন চট্টোপাধ্যায়কে ভোট দিন’। এরই ফাঁকে নজর গেল গোপাল ভবনের উল্টোদিকে একটি দেওয়াল লিখনে। সিপিএম প্রার্থীর সমর্থনে লেখা ওই দেওয়ালে জ্বলজ্বল করছে মেয়রের কার্টুন। সঙ্গে লেখা ‘ত্রিফলা কেলেঙ্কারির নায়ক’, ‘লেকমল কেলেঙ্কারির নায়ক’। যা মেয়রের এত প্রচারের ফাঁকে কিছুটা ‘চোনা’-র মতোই।

গোপাল ভবনের লাগোয়া ফ্ল্যাটের গাড়ি বারান্দায় গোটা চল্লিশেক পুরুষ-মহিলা। কেউ মেয়রের প্রচারের সঙ্গী, কেউ বা সমস্যায় পড়ে মেয়রের সাক্ষাৎপ্রার্থী। তাঁদের বলা হচ্ছে, ‘এখন নয়, ভোটের পরে আসুন।’ অর্থাৎ ভোটের পরে তিনিই যে ফের মেয়র হচ্ছেন, হাবে ভাবে তা বুঝিয়েও দিচ্ছেন। এতটাই আত্মবিশ্বাসী।

Advertisement

এই আস্থার চাবি কাঠি কী? মেয়রের জবাব, কাজের নিরিখেই মানুষ পছন্দ করছে। নিজের ওয়ার্ডের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, ‘‘পুরনো মানুষেরা জানেন, কী হাল ছিল বেহালার। বর্ষায় বেশ কিছু এলাকা জলে ডুবে থাকত। চলাচলের সময়ে হাঁটু অবধি পাঁকে ভরে যেত। এখন আর সেই দুঃসময় নেই।’’ তাঁর দাবি, গত ৫ বছরে তৃণমূল বোর্ডের শাসনে পানীয় জল সরবরাহ বেড়েছে। নিকাশির হাল ভাল হয়েছে। রাস্তায় আলো জ্বলছে। জঞ্জাল অপসারণে নজির সৃষ্টি হয়েছে।

পর্ণশ্রী মোড়ের সেই ঝকঝকে রাস্তা থেকে ডান দিকে একটু ভিতরে ঢুকেই পর্ণশ্রী সমবায় সমিতির পুকুর। একেবারে নোংরা জল। ‘‘জলের রং দেখেই ঘেন্না হয়,’’ বললেন স্থানীয় বাসিন্দা কল্যাণ দাস। পুকুরের দু’পাড় যেন ময়লা ফেলার জায়গা। ডাঁই হয়ে পড়ে প্রতিদিনের উচ্ছিষ্ট। ভোট বলেই হয়তো পুকুরের পাশে রাখা হচ্ছে পুরসভার জঞ্জালের ড্রাম। একটি রিকশায় গোটা কয়েক নতুন ড্রাম নিয়ে ঘুরছেন দুই কর্মী।

পুকুর পাড়ে সিপিএমের পার্টি অফিস। সেখানেই ছিলেন ওয়ার্ডের প্রার্থী রঞ্জন দাশগুপ্ত। বললেন, ‘‘এখনও সংস্কার না হওয়া গোটা কয়েক পুকুর আছে।’’ সংস্কার হয়নি পর্ণশ্রী বাজারেরও। রঞ্জন জানান, কিছু কাজ হয়েছে ঠিকই। তবে এখনও বাবুপাড়া, পর্ণশ্রী পল্লির কিছু এলাকায় পানীয় জলের সমস্যা আছে। ভারী বৃষ্টি হলেই জল জমে পঞ্চাননতলা, গাবতলায়। মেয়র অবশ্য জানান, সব সমস্যার সমাধান হয়েছে এমন দাবি করছি না। কিন্তু পুরনো বেহালার জল-চিত্র যে অনেকটাই বদলেছে, মানছেন পর্ণশ্রীর বাসিন্দা মলয় চট্টোপাধ্যায়ও। বললেন, ‘‘এলাকায় পানীয় জলের অভাব বুঝি না। ভারী বৃষ্টি হলে ঘণ্টাখানেক জল জমে। পরে বেরিয়ে যায়।’’

২০১০ পুরভোটে মেয়রের ওয়ার্ডে মাত্র ৫০০ ভোট পেয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী। লোকসভায় তা বেড়ে সাড়ে পাঁচ হাজার। তবে স্থান তৃতীয়। বামেদের পরে। কিন্তু এক লপ্তে ৫ হাজার ভোট বাড়ায় কি চিন্তিত মেয়র? ‘‘কোনও প্রশ্নই নেই। ভোট ধরে রাখার মতো তাকত এখন বিজেপি-র নেই,’’ জবাব মেয়রের। পাল্টা জবাবে বিজেপি-র তরুণ প্রার্থী বিক্রম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘লোকসভার থেকেও লিড বাড়বে।’’ ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রাক্তন ফুটবলার চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে বিক্রম মাস কয়েক আগে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে এসেছেন। পারিবারিক ব্যবসা প্রোমোটারি। সে প্রসঙ্গ তুলে এক বার খোঁচাও দেন মেয়র। রাখঢাক না করে বিক্রম বলেন, ‘‘গর্বের সঙ্গেই ব্যবসা করি। দু’নম্বরি থাকলে মেয়রের বিরুদ্ধে ভোটে লড়তে সাহস পেতাম না।’’

বিজেপি ও সিপিএম দু’দলের প্রার্থীর মূল বক্তব্য, যেখানে বড় লোকেদের বাস, সেখানে অভিযোগ কম। আর ছোট গলির পাশে থাকা বাসিন্দাদের পানীয় জল ও নিকাশির সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে। মেয়র জানান, খুব শীঘ্রই গার্ডেনরিচে ৫ কোটি গ্যালন জলের প্রকল্প চালু হবে। যাঁরা এখন কম জল পাচ্ছেন, তাঁরা উপকৃত হবেন। পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি জানান, ১৯৮৪ সাল থেকে ২০০৩ পর্যন্ত গার্ডেনরিচ থেকে মাত্র ৩৭ মিলিয়ন গ্যালন জল মিলত। এখন তার পরিমাণ ১৮৫ মিলিয়ন গ্যালন।

গত বার পুরসভার ১৪ নম্বর বরোয় ৯টি ওয়ার্ডের সব ক’টি জিতেছিল তৃণমূল। সব কাউন্সিলরই ফের প্রার্থী তৃণমূলের। মেয়র হওয়ার আগে ১৩২ নম্বর ওয়ার্ডে লড়তেন শোভন। মহিলা সংরক্ষিত হওয়ায় গত বার জেতেন তৃণমূলের সঞ্চিতা মিত্র। কাউন্সিলরের ‘মদতে’ ওয়ার্ডে বেআইনি বাড়ি নির্মাণ নিয়ে সরব কেন্দ্রীয় সরকারি আবাসনের কিছু বাসিন্দা। প্রোমোটারদের সহায়তার জন্য রাস্তা চওড়া দেখিয়ে বিল্ডিংয়ের তল বাড়াতে কেন্দ্রীয় আবাসনের পাঁচিল ভাঙার অভিযোগও উঠেছে। প্রার্থী তথা বিদায়ী কাউন্সিলর সঞ্চিতা অবশ্য তা মানতে চাননি। প্রচারে সে সব বলছেন বামপ্রার্থী শুক্লা ঘোষাল এবং বিজেপি-র সুতপা গুপ্ত।

১৩০ নম্বর ওয়ার্ডে শাসক দলের প্রার্থী অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। প্রচারে হাঁকডাক তেমন না থাকলেও বেহালার মানচিত্র তাঁর নখদর্পণে। বললেন, ‘‘দিদির সঙ্গে বরাবরই রয়েছি। প্রার্থী হওয়ার কথা ভাবিনি। গত বারই (২০১০) দিদি বললেন, ‘‘তুই পুরভোটে দাঁড়া। সেই ভোট রাজনীতির লড়াই শুরু।’’ দু’এক জায়গায় পানীয় জলের সমস্যা আছে। মাস কয়েকের মধ্যে তা-ও ঠিক হয়ে যাবে বলে তাঁর দাবি। মূল প্রতিপক্ষ কে? তাঁর জবাব, ‘‘কেউ নেই। আসলে জেতার জন্য ঘুরছি না। মার্জিন বাড়ানোর জন্য ভোটারদের বলছি।’’ দেওয়াল লিখনে এখানে বিজেপি, সিপিএম পিছিয়ে রয়েছে। কেন? বাম প্রার্থী আরএসপি-র তপন বসু বলেন, ‘‘দেওয়াল পাচ্ছি না। লোকবল এবং অর্থবলও নেই।’’

১২৯ নম্বর ওয়ার্ডের শেষ প্রান্তে একটি পল্লিতে জলের চাপ এত কম, সেখানে পুরসভার গাড়ি গিয়ে জল সরবরাহ করে। আগে সারা দিনে এক বার জলের গাড়ি পৌঁছত। এখন দু’বার। গাড়ি ঢুকতেই শ’খানেক বালতির লাইন পড়ে। ওয়ার্ডের কয়েকটি পকেটে পানীয় জলের সমস্যার কথাই বলছেন সিপিএমের প্রার্থী মৌসুমি চট্টোপাধ্যায়। তৃণমূলের প্রার্থী বিদায়ী কাউন্সিলর সংহিতা দাস বেহালার তৃণমূল নেতা অঞ্জন দাসের স্ত্রী। বললেন, ‘‘শীঘ্রই সেনপল্লিতে বুস্টার পাম্পিং স্টেশন চালু হবে। তাতে পানীয় জলের সমস্যা মিটবে।’’ আর নিকাশি? সংহিতা জানান, বেহালায় বিমানবন্দরের জমিতে একটি ড্রেনেজ পাম্পিং স্টেশন করার প্রকল্প আগেই নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদনের জন্য আটকে ছিল। গত জানুয়ারিতে ছাড়পত্র মিলেছে। কাজ শুরু হবে ভোটের পর। গত লোকসভায় বিজেপি এখানে প্রায় ৬ হাজার ভোট পেলেও পুরভোটে পিছিয়ে।

১৪ নম্বর বরো চেয়ারম্যান মানিক চট্টোপাধ্যায়ের ওয়ার্ড ১২১। জয় নিয়ে নিশ্চিত তৃণমূলের প্রার্থী মানিকবাবু। এত আত্মবিশ্বাস? জবাব, ‘‘কাজের নিরিখে ভোট হলে তৃণমূল ছাড়া অন্য দল জিতবে না।’’ যদিও ওই ওয়ার্ডে এখনও অনেক কাজই বাকি বলে মনে করেন সিপিএম প্রার্থী আশিসবাবু। বিজেপি-র প্রার্থী ইন্দ্রজিৎ মাইতি ইতিমধ্যেই অভিনেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে ঘুরেছেন। বলেন, ‘‘সাড়া পাচ্ছি মানুষের।’’

১২৫ এবং ১২৬ নম্বর ওয়ার্ডে নিকাশির হাল ভাল নয়। ডায়মন্ড হারবার রোডে জল জমার কথা গোপন করেননি চেয়ারম্যান মানিকবাবুও। জানান, নিকাশির হাল ফেরাতে বড় পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ভূগর্ভে বড় বড় পাইপ বসিয়ে চড়িয়াল খালের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। ভোটের পরই প্রক্রিয়া শুরু হবে। ১২৫ এবং ১২৬ ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থী ঘনশ্রী বাগ এবং শিপ্রা ঘটক যাই বলুন না কেন, বাম ও বিজেপি প্রার্থী পুর পরিষেবায় ঘাটতি নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন।

১২৭ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থী শ্যামাদাস রায়। গত লোকসভায় তৃণমূলের সঙ্গে বামেদের ভোটের ব্যবধান ছিল তিনশোর নীচে। গত পুরসভায় প্রার্থীই দিতে পারেনি বিজেপি, অথচ লোকসভায় ৬ হাজার ভোট পেয়েছিল। এ বারও তাঁরা বামেদের ভোট টানবেন বলে মনে করেন বিজেপি প্রার্থী স্বপন দাস। ১২৮ নম্বরেও ভোটের মূল লড়াই পুর পরিষেবার ভিত্তিতেই। তৃণমূলের দোলা সরকার অনেকটা স্বচ্ছন্দ বলে মনে করলেও সিপিএমের রত্নারায় মজুমদার বলেন, ‘‘জোর লড়াই দেব।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement