ফাইল চিত্র।
তাঁর সই ছাড়া কলেজের অ্যাকাউন্টে ছাত্র সংসদ তহবিল হিসাবে থাকা প্রায় ২৫ লক্ষের একটি টাকাও তোলা সম্ভব নয়। অথচ, তিনি ছাত্র সংসদের সদস্য, কলেজের ছাত্র বা শিক্ষক— কোনওটাই নন! সূত্রের খবর, এককালে কলেজে ছাত্র রাজনীতি করার সূত্রে তিনি এলাকার এক রাজনৈতিক নেতা-দাদার ঘনিষ্ঠ হন। সেই সুবাদেই পরে ওই কলেজে শিক্ষাকর্মীর পদে চাকরি। কলেজের বহু বিষয়েই তাঁর প্রভাব অধ্যক্ষের চেয়ে বেশি!
গায়ক কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ ওরফে কেকে-র মৃত্যুর পরে একাধিক প্রশ্ন উঠেছে উল্টোডাঙার স্যর গুরুদাস মহাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে। নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠানস্থলে চূড়ান্ত অব্যবস্থা নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। সেই সূত্রেই সামনে আসে মূল উদ্যোক্তা, কলেজের শিক্ষাকর্মী পঙ্কজ ঘোষের প্রসঙ্গ। জানা যায়, ছাত্র না হলেও পঙ্কজই ওই কলেজের টিএমসিপি ইউনিটের সভাপতি। কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি শান্তনু মল্লিক বলেন, ‘‘দু’বছর করোনায় অনুষ্ঠান হয়নি। ছাত্র সংসদ তহবিলের নামে ব্যাঙ্কে থাকা টাকা তুলে এ বারের অনুষ্ঠান হয়েছে। অধ্যক্ষ এবং পঙ্কজের সই ছাড়া সেই টাকা তোলা সম্ভব নয়। তাই কী ভাবে খরচ হয়েছে, তা-ও ওঁরাই বলতে পারবেন।’’ কিন্তু কোনও শিক্ষাকর্মীর সইয়ে ছাত্র সংসদের তহবিলের টাকা ওঠে কী ভাবে? শান্তনুবাবুর উত্তর, ‘‘ওঁর যা প্রভাব, তাতে নামেই শিক্ষাকর্মী। ওঁকে আটকায় কে?’’
২০১৭ সালের পরে রাজ্যের কোনও কলেজেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পড়ুয়াদেরই অধ্যক্ষকে চিঠি দেওয়ার কথা। পরিচালন সমিতির সঙ্গে আলোচনা করে অধ্যক্ষ অনুমতি দিলে তাঁর ও পরিচালন সমিতির দায়িত্বপ্রাপ্তদের সইয়ের ভিত্তিতে কলেজের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলা যায়। কিন্তু স্যর গুরুদাস মহাবিদ্যালয়ে টাকা তুলতে অধ্যক্ষের পাশাপাশি সই লাগে পঙ্কজেরও। শুধু এটুকুই নয়। কলেজের মানোন্নয়নের সঙ্গে জড়িত যে কোনও আর্থিক লেনদেনেই পঙ্কজের সম্মতি প্রয়োজন। অভিযোগ, ভর্তির সময়ে কোন মেধা-তালিকায় ক’জনের নাম থাকবে, ক’জন প্রথম দফায় ভর্তি হবে আর ক’জন ভর্তি হবে ‘অন্য ভাবে’— সবই স্থির করেন তিনি! পড়ুয়াদের একাংশের দাবি, তাঁকে ভয় পেয়ে চলেন শিক্ষকেরা, অধ্যক্ষও সমঝে চলেন। মতের অমিল হলেই বদলি করে দেওয়ার হুমকি আসে তাঁর তরফে।
কিন্তু এক শিক্ষাকর্মীর এত প্রভাব কী ভাবে? সূত্রের খবর, বাগমারি এলাকার বাসিন্দা পঙ্কজ ২০০৯ সালে ওই কলেজে ঢোকেন। পাশাপাশি শুরু হয় ছাত্র রাজনীতি। প্রথমে উল্টোডাঙা সংলগ্ন এলাকার এক কাউন্সিলরের ছত্রচ্ছায়ায় কাজ করতেন। পরে শাসকদলের এক বিধায়কের ঘনিষ্ঠ হন। তাঁকে ‘জেঠু’ বলে ডেকে তাঁর প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। ২০১৪ সালে তাঁর কলেজে পড়ার মেয়াদ শেষ হলেও কলেজ ছাড়েননি পঙ্কজ। এর পরে, লকডাউনের আগে ওই কলেজেই শিক্ষাকর্মীর চাকরি পান।
কিন্তু এমন ভাবে চাকরি পাওয়া বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয় বলেই দাবি ওয়াকিবহাল মহলের। লকডাউনের আগের দু’বছরে একাধিক কলেজে এ ভাবেই শিক্ষাকর্মী পদে নিয়োগ করা হয়েছে। সূত্রের খবর, সংশ্লিষ্ট কলেজে আগে ছাত্রনেতা হিসাবে থাকা ব্যক্তিরাই ওই চাকরি পেয়েছেন। উত্তর কলকাতার একটি কলেজের শিক্ষাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, যে কোনও অনুষ্ঠানে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থাকে ডাকেন তিনিই। আলো, পাখা-সহ অন্য সরঞ্জামও নিতে হয় তাঁর থেকে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত এক শিক্ষাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, আগে অটো চালালেও পরে ছাত্রনেতা থেকে শিক্ষাকর্মী হয়ে গিয়েছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের সংস্কারের কাজে তাঁর পরিচিত ঠিকাদারকেই নিয়োগ করা হয়। ক্যান্টিনও চালান তাঁরই আত্মীয়!
দক্ষিণ কলকাতার একটি কলেজের ছাত্র সংসদ চালানো, চল্লিশোর্ধ্ব শিক্ষাকর্মীর বিরুদ্ধে পড়ুয়াদের মন্তব্য, ‘‘অপছন্দের শিক্ষকেরা ক্লাস নেওয়ার সময়ে উনি চাইলেই বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেন। উনিই ঠিক করেন, কোন শিক্ষকের গাড়ি কলেজ চত্বরে থাকবে, কোনটি নয়।’’ যদিও এই সব অভিযোগই অস্বীকার করেছেন ওই শিক্ষাকর্মীরা। পঙ্কজ অবশ্য বলছেন, ‘‘ছেলেরা ভালবাসে, তাই রয়েছি। যে দিন মনে হবে, ছেড়ে দেব।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।