বরো-১৩

হাল ফিরবে পরিষেবার, আশ্বাসই অস্ত্র প্রচারের

গত পুরভোটে একটাও আসন পায়নি বিরোধীরা। এমনকী, ২০১৪-র লোকসভা ভোটের নিরিখেও কলকাতা পুরসভার ১৩ নম্বর বরোর মোট ন’টি ওয়ার্ডে বিরোধীরা কোথাও খাতা খুলতে পারেনি। বিজেপি-র মোদী ঝড়ের পরিস্থিতিতেও এই বরোয় শুধু ১১৭ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি ছিল দ্বিতীয় স্থানে।

Advertisement

কৌশিক ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১০
Share:

গত পুরভোটে একটাও আসন পায়নি বিরোধীরা। এমনকী, ২০১৪-র লোকসভা ভোটের নিরিখেও কলকাতা পুরসভার ১৩ নম্বর বরোর মোট ন’টি ওয়ার্ডে বিরোধীরা কোথাও খাতা খুলতে পারেনি। বিজেপি-র মোদী ঝড়ের পরিস্থিতিতেও এই বরোয় শুধু ১১৭ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি ছিল দ্বিতীয় স্থানে। বাকি সব ক’টিতেই বামফ্রন্ট ছিল তৃণমূলের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রশ্ন উঠছে, আসন্ন পুর-নির্বাচনে বাম বা বিজেপি কি এই এলাকায় আঁচড় কাটতে পারবে? এই দুই দল তাদের দুর্গে আদৌ ফাটল ধরাতে পারে কি না, সেটাই হবে তৃণমূলের পরীক্ষা। এলাকায় তৃণমূলের বহু নেতাই সরাসরি বলছেন, ফেলের তো কোনও প্রশ্নই নেই। সব ক’টি ওয়ার্ডে প্রার্থীরা স্টার মার্কস রাখতে পারেন কি না, সেটাই আলোচ্য। এই বরোয় শক্তি পরীক্ষার জন্য কয়েকটি ওয়ার্ডে প্রার্থী দিয়েছে সিপিআইএমএল (নিউ ডেমোক্রেসি)। কোথাও কোথাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কংগ্রেসও।

Advertisement

১১৫, ১১৬, ১১৭, ১১৮, ১১৯, ১২০, ১২২, ১২৩ এবং ১২৪ ওয়ার্ড নিয়ে পুরসভার এই বরো। মূল সমস্যা পানীয় জল সরবরাহ এবং নিকাশি। নিকাশি সমাধানে কলকাতা পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্পে প্রথম পর্যায়েই এই বরোয় সংস্কার শুরু হয়েছিল। পানীয় জলের জন্য দাসপাড়া এবং সিরিটিতেও বুস্টার পাম্পিং স্টেশন হয়েছে। বরো চেয়ারম্যান সুশান্ত ঘোষ বলেন, ‘‘বরোয় সব সমস্যা মিটেছে তা নয়। প্রায় সব ওয়ার্ডেই পানীয় জলের সমস্যা অল্প রয়ে গিয়েছে। গার্ডেনরিচের বাড়তি জল এলে পুরো সমস্যা কাটবে। জল জমার সমস্যা আগের চেয়ে অনেকটা কমলেও পুরো যায়নি। যেখানে কাজ বাকি, সেখানে পুরসভা নিকাশি সংস্কার করেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শেষ না হলে পুরো ফল মিলবে না।’’

পানীয় জলের দাবি নিয়েই সোচ্চার মতিলাল গুপ্ত রোড সংলগ্ন ১২২ নম্বরের সিপিএম প্রার্থী কোয়েল বিশ্বাস। তাঁর কথায়, ‘‘পানীয় জল নেই। এই পুরবোর্ড কোনও কাজই করেনি।’’ একই অভিযোগ বাসিন্দাদের একাংশেরও। স্থানীয় কাউন্সিলর এবং তৃণমূল প্রার্থী সোমা চক্রবর্তীও এলাকায় জলকষ্টের কথা মেনেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘জুন মাস নাগাদ গার্ডেনরিচের জল এলেই সমস্যা মিটবে।’’ ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য। গত পুর নির্বাচনে এই ওয়ার্ডেই সিপিএমের টিকিটে দাঁড়িয়েছিলেন। এ বার বিজেপিতে কেন? শর্মিষ্ঠা বলেন, ‘‘সিপিএমের কোনও নৈতিকতা নেই বলে মনে হয়েছে। তাই বিজেপিতে এসেছি। টিকিট পাওয়ার লোভে নয়।’’ ওয়ার্ডে সিপিআইএমএল প্রার্থী রাখী রায়। বেহালা সিপিআইএমএল (নিউ ডেমোক্রেসি)-র আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক বিমল মণ্ডলের দাবি, ‘‘২০০৫ থেকেই বেহালায় পুরভোটে মানুষের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে ল়ড়ছি আমরা। আমি নিজেও এ বার ১১৫ নম্বর ওয়ার্ডে দাঁড়িয়েছি।’’

Advertisement

১১৭ নম্বর ওয়ার্ডের অনেকটা জুড়ে জ্যোতিষ রায় রোড। বরোয় একমাত্র এই ওয়ার্ডেই গত লোকসভা ভোটে তৃণমূলকে কিছুটা হলেও বেগ দিয়েছিল বিজেপি। তাদের চেয়ে মাত্র ১৩২টি ভোট বেশি পেয়েছিল তৃণমূল। বিজেপি প্রার্থী সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘লোকসভার নিরিখে আমরাই এখানে দ্বিতীয়। পুর-পরিষেবা বলতে কিছু নেই। তাই আমার জয় নিশ্চিত।’’ ওয়ার্ডের বতর্মান তৃণমূল কাউন্সিলর শৈলেন দাশগুপ্ত ফের দলীয় প্রার্থী। মনোনয়নের আগে ঠিক হয়েছিল, তাঁর স্ত্রী কল্যাণী দাশগুপ্ত এখানে প্রার্থী হচ্ছেন। পরে শৈলেনবাবুকেই প্রার্থী করা হয়। কল্যাণীদেবী বলেন, ‘‘শোনা গিয়েছিল এই ওয়ার্ড মহিলা-সংরক্ষিত হবে। তাই আমাকে মনোনয়ন দেওয়ার কথা হয়।’’ প্রচারে স্বামীর সঙ্গে সামিল তিনিও।

১২৪ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী রাজীবকুমার দাস। ওয়ার্ডটি (তফসিলি) সংরক্ষিত হয়ে যাওয়ায় বর্তমান কাউন্সিলর ইন্দ্রজিৎ ভট্টাচার্য সরেছেন ১৪৩ নম্বর ওয়ার্ডে। এই অঞ্চলে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটব্যাঙ্কও রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা মতুয়া সম্প্রদায়ের সদস্য রাজীববাবুকে টিকিট দেওয়া হয়েছে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি মতুয়া সম্প্রদায়ের। বড়মার পরিবারেরও ঘনিষ্ঠ।’’ একই কৌশল বিজেপি-রও। দলীয় প্রার্থী সঞ্জয় বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমিও তো মতুয়া সম্প্রদায়েরই। এখানকার সম্প্রদায়ের সকলেই আমাকে ভোট দেবেন।’’ সিপিএম প্রার্থী সুধীর মালাকারের দাবি, মূলত পানীয় জল, মশা এবং নিকাশির সমস্যা তাঁকে অনেকটাই এগিয়ে রাখবে।’’ বাসিন্দাদের বক্তব্য, শীলপাড়া অঞ্চলে অনেক নতুন রাস্তা হয়েছে। আলোও রয়েছে। তবে পানীয় জলের সমস্যাও আছে।

১১৫ নম্বরে এ বারও তৃণমূলের প্রার্থী বর্তমান কাউন্সিলর রত্না শূর। হরিদেবপুর এবং ব্যানার্জিপাড়া সমেত বিস্তীর্ণ অংশ এই ওয়ার্ডে। স্থানীয় বাসিন্দা সুব্রত গুহ বলেন, ‘‘জলের সমস্যা কমেছে। কিন্তু মশার উৎপাত প্রচণ্ড।’’ রত্নাদেবী বলেন, ‘‘খালধারে মশার উৎপাত আছে। খাল পরিষ্কার রাখায় গুরুত্ব দিয়েছি।’’ সিপিএম প্রার্থী শুভঙ্কর বাগচী বলেন, ‘‘পুর-পরিষেবাকে হাতিয়ার করেই আমার ভোটযুদ্ধ। সাড়াও পাচ্ছি।’’ গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল এখানে ২৬৩৭ ভোটে জিতেছিল।

১১৬ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী বর্তমান কাউন্সিলর কৃষ্ণা সিংহ। তিনি তৃণমূল নেতা, মেয়র পারিষদ তারক সিংহের মেয়ে। বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, পানীয় জলের চাপ কম। নিকাশির সমস্যাও আছে।’’ কৃষ্ণাদেবী অবশ্য বলেন, ‘‘জল, আলো, রাস্তা ও নিকাশির কাজ যতটা সম্ভব হয়েছে। মূলত এখানে বস্তি এলাকায় প্রচুর উন্নয়ন করেছি।’’ ওয়ার্ডের সিপিআই প্রার্থী স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পুর-পরিষেবার ঘাটতি নিয়েই ভোটে নেমেছি। সাড়াও মিলছে। তা ছাড়া, কাউন্সিলর তো এখানে থাকেনই না। কাজ করবেন কী করে?’’

এস এন রায় রোডে ১১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মেয়র পারিষদ তারক সিংহ। এখানে বাসিন্দাদের অভিযোগ নিকাশি এবং পানীয় জলের সমস্যা নিয়ে। তারকবাবু বলেন, ‘‘সমস্যা একেবারে নেই, তা নয়। কিন্তু উন্নতি হয়েছে।’’ তাঁর বিপরীতে সিপিএমের অজয় অধিকারী। অজয়বাবুর কথায়, ‘‘পুর-পরিষেবার ভিত্তিতেই ভোট হচ্ছে। সেটা এখানে নেই। সুতরাং সুষ্ঠু ভোট হলে না জেতার কোনও কারণ নেই।’’

ডায়মন্ড হারবার রোড সংলগ্ন এস এন রায় রোডের একাংশে ১১৯ নম্বর ওয়ার্ডেও মূল অভিযোগ পানীয় জল সরবরাহ এবং পার্ক নিয়ে। স্থানীয় বাসিন্দা কৃষ্ণ রায়ের অভিযোগ, জঞ্জাল অপসারণেও সমস্যা আছে। তবে কাউন্সিলর অশোকা মণ্ডলের দাবি, ‘‘পানীয় জল সরবরাহে অনেক কাজই হয়েছে। এই সমস্যা রয়েছে বহুতলে। পুর-পরিষেবায় কোনও ঘাটতি নেই। মদের ঠেক তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আধুনিক কম্প্যাক্টর মেশিন বসেনি এখনও।’’ অশোকাদেবী এ বারেও প্রার্থী। ওয়ার্ডে বিজেপি প্রার্থী যসবীর কৌর। কিন্তু পুরভোটে তাঁদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। এখানে প্রথমে বিজেপি-র প্রার্থী হন চন্দ্রা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। কেন? চন্দ্রাদেবী শুধু বলেন, ‘‘ব্যক্তিগত কারণেই এই সিদ্ধান্ত।’’ অন্য দিকে, বর্তমান বিজেপি প্রার্থী যসবীর কৌর বলেন, ‘‘নির্বাচনের আগেই এখানে চলছে তৃণমূলের সন্ত্রাস।’’

সেনহাটি বাজার সংলগ্ন ১২০ নম্বর ওয়ার্ডে অধিকাংশ বাসিন্দার অভিযোগ, এলাকায় জলের চাপ কম। বর্তমান কাউন্সিলর এবং ১৩ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান সুশান্ত ঘোষ এ বারও তৃণমূলের প্রার্থী। তাঁর জবাব, ‘‘গার্ডেনরিচ থেকে বাড়তি জল কয়েক মাসের মধ্যেই পাওয়া যাবে।’’ এই ওয়ার্ড বরাবরই কংগ্রেসের। সেই সু্যোগই কাজে লাগাতে চান দলীয় প্রার্থী দেবাশিস ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘এখানে কংগ্রেসের ভোট ছাড়াও চারমুখী লড়াইতে ভোট ভাগ হবে। ভোট ভাগাভাগিতে কংগ্রেস জিতবে।’’

জেমস লং থেকে চুয়ারবোন সংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকা ১২৩ নম্বর ওয়ার্ডে। এখানেও বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, পানীয় জলের সমস্যা আছে। তবে নিকাশির অবস্থা আগের চেয়ে ভাল। তৃণমূল কাউন্সিলর সুদীপ পোল্লে এ বারেও দলীয় প্রার্থী। গত পুরভোটে মাত্র ৭৩ ভোটে জিতেছিলেন। এ বার কী অবস্থা? এলাকার বেশ কয়েক জন তৃণমূল নেতা-কর্মী মনোনয়ন পর্ব থেকেই বিরোধিতা করছেন। কাউন্সিলর তথা প্রার্থীর উত্তর, ‘‘কাজের মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছি। চুয়ারবোনের মতো জায়গায় আমূল সংস্কার করেছি। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে মাথা ঘামাই না।’’ বিজেপি প্রার্থী সুদীপ মাইতি বলেন, ‘‘২০১০-এ পুরভোটে এখানে বিজেপি-র প্রার্থী ছিল। লোকসভা নির্বাচনেও অনেক ভোট বিজেপি পায়। এ বার আমাদের সংগঠন বেড়েছে। না জেতার কারণ নেই।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement