ঐতিহ্য: ভোটাভুটির অপেক্ষায় কফিহাউস। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
সদ্য স্বাধীন দেশে সে এক ভারতবিশ্রুত ঠিকানার গল্প। নারী, পুরুষের ভেদ মানে না। ধার ধারে না ঝকঝকে পরিচ্ছদ বা রূপটানেরও। যেন, স্রেফ শব্দের মৌচাকে তৈরি। কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকর্মী, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, মেধাবী ছাত্রদের যা আকর্ষণ করে। ট্যাঁকে টানাটানির দিনেও দু’-এক দফা কড়া ইনফিউশনের আবেশে বুঁদ হয়ে নির্ভাবনায় কাটানো যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কেউ উঠে যেতে বলে না!
আড্ডা বা আড্ডাবাজদের চরিত্র পাল্টেছে এ কালে। তবু কফিহাউস আজও কলকাতার একটি পরিচয়। ইতিহাসের গন্ধমাখা সাবেক অ্যালবার্ট হল তথা কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে এখন অন্য উৎকণ্ঠা! করোনাকালে দরজা খুললেও কফিহাউস কর্মীদের সমবায়ের ভোটাভুটি আটকে রয়েছে। ফলে অন্তত ৮০ বছরের পুরনো আড্ডাক্ষেত্রের রক্ষণাবেক্ষণ ধাক্কা খেতে পারে বলে আশঙ্কা!
মোটামুটি ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তার পথচলা শুরু। সুভাষচন্দ্রের মহানিষ্ক্রমণের খবরে সে-দিন কলকাতা উত্তাল। কফিহাউসের ভার তখন কফি বোর্ডের জিম্মায়। ১৯৫৮ পর্যন্ত সে-ভাবেই চলছিল। এর পরে কফিহাউস কর্মীদের সমবায় সব কিছুর দায়িত্ব নেয়। হস্তান্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সহায়তায় সক্রিয় হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। জায়গাটার লিজ় অবশ্য কফি বোর্ডেরই হাতে ছিল। ১৯৯৬ সালে সেই লিজ়ের মেয়াদ ফুরোলে মাঠে নামেন তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বাড়িটির লিজ় কিনে রাজ্য সরকারই তখন নামমাত্র টাকার বিনিময়ে কফিহাউস কর্মীদের প্রতিষ্ঠান চালাতে দিয়েছে।
সেই ‘ইন্ডিয়ান কফি ওয়ার্কার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’-এর পাঁচ বছর অন্তর ভোটাভুটিতে বোর্ড গঠন করার কথা। বোর্ডের মেয়াদ জুলাইয়ে ফুরিয়েছে। রাজ্য সমবায় দফতরের দায়িত্ব ফের ভোট করানো। কফিহাউসের পুরনো মুখ ‘কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস গোয়ার্স ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র কর্তা স্বাধীন মল্লিকের বক্তব্য, “ভোটের মাধ্যমে নতুন বোর্ড দায়িত্ব না নিলে মুশকিল। খাতায়কলমে দায়িত্ব ছাড়া পুরনো বোর্ডের কফিহাউসের রক্ষণাবেক্ষণে কিছুই করার এক্তিয়ার নেই।” কফিহাউস পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত সমবায়ের সম্পাদক তপন পাহাড়ি বলছেন, “আমরা ইতিমধ্যে সমবায় দফতরে চিঠি দিয়েছি। আমরাও চাই, দ্রুত ভোটাভুটি হোক।”
সমবায়মন্ত্রী অরূপ রায়ও কফিহাউসের বিষয়টি জানেন। তিনি বলছেন, “কোভিডের জন্য রাজ্যে কম-বেশি ৭৫টি সমবায়ের ভোট আটকে। দফতরের নির্বাচন কমিশন বিষয়টি দেখছে। কফিহাউসের বিষয় নিয়ে আমিও কথা বলব।”
পুরনো কফিহাউসপ্রেমীদের একাংশও মনে করেন, রোজকার কফিহাউস পরিচালনায় কিছুটা সরকারি আগ্রহ বা সংস্কৃতিপ্রেমীদের মনোযোগ জরুরি। তাতে কফিহাউস নিয়ে লোকের আগ্রহ বাড়বে। স্বাধীনবাবুরা বলছেন, “১৯৬০-৭০ এর দশকের কলকাতা আর নেই। কবি, লেখকদের এখন আড্ডার অন্য অনেক জায়গা। শহরে অজস্র এসি কফি শপ। কফিহাউসের পুরনো চেহারা অটুট রাখলেও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক কিছু করার আছে!” তাঁদের অভিযোগ, খাবারের মান ভাল নয়! ভাল শেফ নেই। হেঁশেলের কাজ চলছে কর্মচারীদের বংশানুক্রমে। সাবেক কাঠের আসবাব সরিয়ে প্লাস্টিকের চেয়ারও কদাকার। এবং শৌচাগারের রক্ষণাবক্ষণ, পরিচ্ছন্নতায় নানা খামতি। সব মিলিয়ে
কফিহাউস অভিভাবকের অভাবে ভুগছে।
“এখন নানা পেশার মানুষজন আসেন! নন্দনের জায়গাটা গড়ে ওঠার পর থেকেই কবি, লেখকেরা কমে গিয়েছেন কফিহাউসে”, বলছিলেন প্রবীণ কবি মৃদুল দাশগুপ্ত। ১৯৬৯ থেকে কফিহাউসে তাঁর যাওয়া-আসা। তবে কয়েক বছর আগে প্রয়াত উৎপলকুমার বসুর মতো কাউকে কাউকে আমৃত্যু কফিহাউসে আসতে দেখেছেন তিনি। চিত্রপরিচালক, কবি অয়ন চক্রবর্তীর মতো তরুণতররাও কফিহাউসে আসেন! এমন অনেকের কাছেই, খাবারের উৎকর্ষ নয়, আড্ডার পরিবেশটাই বড় কথা। ‘কফিহাউস সোশ্যাল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক অচিন্ত্যকুমার লাহা আশাবাদী, “দ্রুত ভোটাভুটি মিটে গেলে কফিহাউসও তার পুরনো মহিমা রক্ষায় মন দেবে।”