মুশকিল: কম সময়ে রাস্তা পেরোতে অসুবিধায় পড়েন বয়স্করা। বৃহস্পতিবার, গিরিশ পার্কে। ছবি: সুমন বল্লভ
কতটা দ্রুত হাঁটলে তবে রাস্তা পেরোনো সম্ভব? দীর্ঘদিন ধরে এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে শহরের প্রবীণদের একটা বড় অংশের মধ্যে। তাঁদের অভিযোগ, বহু ট্র্যাফিক সিগন্যালই পথচারীদের জন্য এতই কম সময় খোলা থাকে যে, হেঁটে ওই সময়ের মধ্যে রাস্তা পার হওয়াই মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়! একই সমস্যায় পড়েন অসুস্থ পথচারীরা। কলকাতা পুলিশ বয়স্কদের নিয়ে নানা প্রকল্পের কথা বললেও এ নিয়ে হেলদোল নেই ট্র্যাফিক বা লালবাজারের কমিউনিটি পুলিশ— কোনও পক্ষেরই।
দিন কয়েক আগে একটি আলোচনাচক্রে কলকাতা কমিউনিটি পুলিশের আধিকারিক তথা ‘প্রণাম’-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ কথাই জানিয়েছিলেন বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলি টাউনশিপের বাসিন্দা গোবিন্দ মিত্র। অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার বছর আটষট্টির গোবিন্দবাবু দাবি করেন, ইএম বাইপাসের পাটুলি মোড়ের সিগন্যাল কখনই পেরোতে পারেন না তিনি। মাঝপথে যেতে না যেতেই গাড়ির সিগন্যাল সবুজ হয়ে যায়। তাঁর কথায়, ‘‘পাটুলি মোড়ের ওই রাস্তা প্রায় ৩০ মিটার চওড়া। অঙ্ক কষে দেখেছি, কোনও বয়স্কের হাঁটার গতি যদি ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটার হয়, তা হলে ওই রাস্তা পার হতে তাঁর ২০ সেকেন্ড লাগার কথা। কিন্তু এই সিগন্যাল পথচারীদের জন্য খোলা থাকে মাত্র ১০ সেকেন্ড।’’ গোবিন্দবাবুর দাবি, বয়স্করা তো দূর, কোনও যুবকের পক্ষেও না দৌড়ে ওই রাস্তা এক বারে পেরোনো অসম্ভব।
পুলিশ সূত্রের খবর, শহরের প্রায় সব বড় রাস্তার মোড়ের ট্র্যাফিক সিগন্যালই পথচারীদের জন্য ১০-১৫ সেকেন্ড খোলা থাকে। একমাত্র ব্যতিক্রম ধর্মতলা এবং পার্ক সার্কাস সাত মাথার মোড়, যেখানে ওই সিগন্যাল খোলা থাকে প্রায় ২০ সেকেন্ড। ১০ সেকেন্ডের মধ্যে এক বৃদ্ধকে রাস্তা পেরোতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে দেখা গেল ইএম বাইপাস কাদাপাড়া মোড়ে। কোনওমতে রাস্তার এক দিকের ফ্ল্যাঙ্ক পার করে ডিভাইডার পর্যন্ত পৌঁছে তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে হল দীর্ঘক্ষণ। দু’বার পথচারীদের সিগন্যাল সবুজ হলেও হেঁটে উল্টো দিকের রাস্তা পার হওয়ার সাহস দেখাতে পারলেন না তিনি। স্বপন সরকার নামে বছর বাহাত্তরের ওই বৃদ্ধ বলেন, ‘‘লাভ কী? এখনই তো ফের গাড়ি ছেড়ে দেবে!’’ কিন্তু পাশেই তো সাবওয়ে। সেই পথ ব্যবহার না করার কারণ? থামিয়ে দিয়ে স্বপনবাবু বললেন, ‘‘সাবওয়ের সব ক’টি চলমান সিঁড়ি তো বন্ধ। এই বয়সে আর সিঁড়ি ভাঙতে পারি না।’’ একই অবস্থা চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের গিরিশ পার্ক মোড়েও। পুজোর ক’দিন সেখানে দড়ি ধরে পথচারীদের রাস্তা পার করানোর বন্দোবস্ত ছিল। এখন ভরসা সিগন্যালের বেঁধে দেওয়া সেই ১০ সেকেন্ড। মানিকতলার সৌমেন বক্সীর আবার প্রশ্ন, ‘‘বহু অসুস্থ মানুষকেও ট্র্যাফিক সিগন্যালে আটকে থাকতে দেখেছি। অস্ত্রোপচারের পরে তাঁদের অনেকেরই হাঁটার গতি কমে যায়। তাঁদের জন্য কী হবে?’’
লালবাজার সূত্রের খবর, ট্র্যাফিক বিভাগের প্ল্যানিং এবং সার্ভে শাখা ট্র্যাফিক গার্ডের সঙ্গে বিভিন্ন সিগন্যালের সময় পর্যালোচনা করে। ২০১৮ সালের ট্র্যাফিক পুলিশ রিভিউ বৈঠকে সিগন্যালে পথচারীদের জন্য পর্যাপ্ত সময় রাখা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছিল। সেখানে ঠিক হয়, পথচারী, যানবাহনের চাপ এবং সংখ্যার উপরে ভিত্তি করে বিভিন্ন ট্র্যাফিক সিগন্যাল খোলা-বন্ধের সময় নির্ধারণ করা হবে।
প্রশ্ন উঠেছে, এ সবের মধ্যে কি বয়স্ক এবং অসুস্থদের কথা ভেবে সিগন্যাল খোলা-বন্ধের সময় নির্ধারণ করতে ভুলে গিয়েছে লালবাজার?
কলকাতার কমিউনিটি পুলিশের আধিকারিক সত্যজিৎবাবু বলেন, ‘‘বয়স্কদের নিরাপত্তা কলকাতা পুলিশের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমস্যাটি নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হবে।’’ কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্র্যাফিক) অখিলেশ চতুর্বেদী বললেন, ‘‘পাটুলি বা কাদাপাড়ার সিগন্যালগুলি দেখে নেওয়া হচ্ছে। এর একটা পাকাপাকি সমাধানেরও দ্রুত চেষ্টা করা হবে।’’
পথ-সুরক্ষা এর পরেও চেষ্টার পর্যায়ে থাকবে কেন? সেই প্রশ্নের অবশ্য উত্তর মেলেনি।