দুর্ঘটনাস্থল: ঘিরে রাখা এই বাতিস্তম্ভের পাশে ঝুলতে থাকা তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েই ঋষভের মৃত্যু হয় বলে অনুমান পুলিশের। বুধবার, রাজভবনের নর্থ গেটের কাছে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
রাজ্য সরকারের তরফে ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে মৃত যুবকের পরিবার তা নিতে অস্বীকার করল। বদলে যাদের জন্য ছেলের প্রাণ অকালে চলে গেল, তাদের কঠোর শাস্তির দাবি তুললেন মৃতের বাবা।
রাজভবনের নর্থ গেটের সামনে মঙ্গলবার বিকেলে জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় ফরাক্কার বাসিন্দা, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ঋষভ মণ্ডলের (২৫)। বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে রাজভবনের পাশ দিয়ে বাস ধরতে আসছিলেন ঋষভ। তখনই একটি বাতিস্তম্ভের পাশে জমা জলে পিছলে পড়ে যান তিনি। পুলিশ সূত্রের খবর, বাতিস্তম্ভের পাশ দিয়ে একটি বৈদ্যুতিক তার ঝুলে ছিল। তারে লেগে কোনও ভাবে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান ঋষভ।
মর্মান্তিক এই ঘটনার পরে প্রশ্ন উঠেছে, রাজভবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বাতিস্তম্ভ থেকে এই ভাবে বিদ্যুতের তার ঝুলে ছিল কেন? সিইএসসি-র তরফে জানানো হয়েছে, বাতিস্তম্ভটি কলকাতা পুরসভার। সেটি দেখভালের দায়িত্ব তাদের নয়। তবে মাটির নীচে যাবতীয় বৈদ্যুতিক সংযোগ তারা নজরে রাখে। এই ঘটনায় তদন্ত কমিটি গড়ার নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতা পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান তথা রাজ্যের পরিবহণ ও আবাসন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।
অভিযোগ উঠেছে, বাতিস্তম্ভ থেকে বিদ্যুতের তার টেনে ফুটপাতের হকারেরা অবৈধ ভাবে ব্যবহার করেন। কলকাতা পুরসভার আলো বিভাগের ইঞ্জিনিয়ারদের বক্তব্য, বাতিস্তম্ভ পুরসভার হলেও সেখান থেকে তার টানার অনুমতি তারা দেয় না। সেটার উপরে নজরদারির কাজ সিইএসসি-র। যদিও সিইএসসি-র তরফে সাফ জানানো হয়েছে, বাতিস্তম্ভগুলি দেখভালের দায়িত্ব কলকাতা পুরসভার। সেখান থেকে কেউ অবৈধ ভাবে তার টানছে কি না, তা-ও পুরসভারই দেখার কথা।
এই টানাপড়েনের মধ্যে ঋষভের পরিবারের প্রশ্ন, ‘‘এই মৃত্যুর দায় কে নেবে?’’ ফরাক্কার এনটিপিসি মোড়ের বাসিন্দা মনোজকুমার মণ্ডল ও বিপাশা মণ্ডলের দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে ছোট ঋষভ বরাবরই মেধাবী ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে এমটেক উত্তীর্ণ ঋষভ বছর দুয়েক আগে কলকাতায় এক নামী সংস্থায় কাজে যোগ দেন। রাজভবনের কাছেই তাঁর অফিস ছিল। ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পরে মঙ্গলবার সারা রাত ঘুমোননি বাবা-মা। বাবার ছোট ওষুধের দোকান রয়েছে। বুধবার টেলিফোনে বাবা মনোজকুমার মণ্ডল ভাঙা গলায় বলেন, ‘‘ছেলেটাকে কষ্ট করে লেখাপড়া শেখালাম। চাকরিও পেল। কিন্তু কী যে হয়ে গেল! এই মৃত্যুর দায় কে নেবে? ক্ষতিপূরণ নিলে ছেলে ফিরবে না। দোষীদের কঠোর শাস্তি চাই।’’ ঋষভের দিদি বিজেতা মণ্ডল বহরমপুর থেকে টেলিফোনে বলেন, ‘‘রাজভবনের সামনেই বাতিস্তম্ভ থেকে ইলেকট্রিকের তার ঝুলছে! সেখানে যদি এই হাল হয় তা হলে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়? এ দিকে এত উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। আমরা নিরপেক্ষ তদন্ত চাই।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী ঋষভের মৃত্যু হয়েছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। এ দিন বিকেলে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের একটি দল ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে। একাধিক বাতিস্তম্ভ পরীক্ষা ও নমুনা সংগ্রহ করেন তাঁরা। প্রাথমিক ভাবে অনুমান,
বাতিস্তম্ভের নীচের বক্স থেকে হুকিং করা হয়েছিল ফুটপাতের কোনও দোকানের জন্য। সেটিরই তার ছিল জলের মধ্যে। সেই তারে লেগেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছেন ওই যুবক। তবে রাত পর্যন্ত এ নিয়ে কোনও অভিযোগ জমা পড়েনি বলে পুলিশ সূত্রের খবর। পুলিশের প্রাথমিক ভাবে অনুমান, হুকিংয়ের জন্য একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। যারা টাকার
বিনিময়ে হুকিং করে বিদ্যুৎ দিত ফুটপাতে বসা হকারদের।
বুধবার চেতলায় এক অনুষ্ঠানে ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘বিদ্যুৎ চুরি রুখতে সিইএসসি-কে বলেছি। পুরসভার ইলেকট্রিক্যালের ডিজিকেও বলেছি, যাঁর ওখানে দায়িত্ব তাঁকে শোকজ করুন। শহর জুড়ে বিদ্যুৎ চুরি করে কিছু অসাধু মানুষ ব্যবসা করছে। আর তাদের জন্য মানুষের প্রাণ যাবে, সেটা হতে পারে না।’’ ফিরহাদের ক্ষোভ, ‘‘আগেও খিদিরপুর, রামনগরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে। সিইএসসিকে বলেছি, কঠোর হতে। কলকাতা পুলিশের কমিশনারকে অনুরোধ করব, সিইএসসি-র সঙ্গে বিদ্যুৎ চুরির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হোক।’’ এ প্রসঙ্গে রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বুধবার বলেন, ‘‘বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে, সেটা ঠিকই। শহরের বিদ্যুতের পুরোটাই দেখে সিইএসসি। আমার সচিবের সঙ্গে কথা বলে সিইএসসি-র সঙ্গে শীঘ্রই আলোচনায় বসব।’’