কালির জুজুতে ভিড় উধাও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে। বুধবােরর লাইন (উপরে) দেখা গেল না বৃহস্পতিবার (নীচে)। — নিজস্ব চিত্র
পাঁচশো এবং হাজার টাকার নোট বাতিলের পরে পুরসভার কর দেওয়ার হিড়িক বাড়ছে। গত সাত দিনে যা প্রায় সাড়ে ৩৫ কোটি টাকা ছুঁয়েছে। অথচ গত বছরে এই সময়ে তার পরিমাণ ১৫ কোটির মতো ছিল বলে পুরসভা সূত্রের খবর। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি পাঁচশো এবং হাজার টাকার নোট বাতিলের আগে শেষ সুযোগ নিতে ভিড় বাড়াচ্ছেন করদাতারা?
ভিড়ের ধরন দেখে প্রথমটায় তেমনই আঁচ করেছিলেন অনেকে। কিন্তু তার বাইরেও অন্য এক ‘লাভের’ সন্ধান পেয়েছেন করদাতারা। পুরসভা সূত্রেরই খবর, সম্পত্তি কর জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে সুদের উপর একটা ‘ছাড়’ মিলছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কর আদায়ের পরিমাণ বাড়াতেই ওই ব্যবস্থা বলে কেউ কেউ মনে করছেন। আর কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য এটাকে বেআইনি প্রবণতা বলেই অ্যাখ্যা দিচ্ছেন। যদিও মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশেই বাতিল বলে ঘোষিত পাঁচশো এবং হাজার টাকার নোটও নেওয়া হচ্ছে।’’
বৃহস্পতিবার পুরসভার এক আমলা জানান, এখন যাঁরা সম্পত্তিকর দিচ্ছেন, তাঁদের একটা অংশ সাধারণ মধ্যবিত্ত, যাঁদের ঘরে ২০-৫০ হাজার টাকা রয়েছে। তার সিংহভাগ ৫০০ এবং হাজারের নোটে। তাঁরা বুঝছেন, ব্যাঙ্কে টাকা জমা দেওয়ার যে ঝামেলা, তার চেয়ে পুরসভার বকেয়া কর মেটাতে ওই টাকার সদ্ব্যবহার করা অনেক ভাল। আরেকটা অংশ রয়েছে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে সম্পত্তিকর বকেয়া রেখেছেন। এখন নোট বাতিলের আশঙ্কায় বকেয়া কর জমা দেওয়ায় উদ্যোগী হয়েছেন। মিলছে সুদের বিশেষ ছাড়ও। উদাহরণ দিয়ে তিনি জানান, এমন করদাতা রয়েছেন, যাঁর বকেয়া ছিল ২০ লক্ষেরও বেশি। সুদ ছিল ৫ লাখ টাকার মতো। বিশেষ ছাড়ের জন্য তিনি আড়াই লাখ টাকার ছাড় পেয়েছেন।
তবে এই শ্রেণির টাকা পুরকর হিসেবে জমা পড়তেই প্রশ্ন উঠছে, তাঁরা হয়তো কালো টাকা সাদা করতেই ভিড় বাড়াচ্ছেন। যদিও সে ধরনের সম্ভবনার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন স্বয়ং মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘পুরসভা সম্পত্তিকর নেয় বছরভর। কলকাতায় যাঁদের সম্পত্তি রয়েছে, ধনী মধ্যবিত্ত যাই হোন না কেন, কর দিতেই হবে। শহরে যাঁদের দোকান বা অন্য ব্যবসা রয়েছে, বাদ যান না তাঁরাও। বছর বছর লাইসেন্স ফি দিতে হয় তাঁদের। এ ক্ষেত্রে সম্পত্তি কর এবং লাইসেন্স ফি নিতে পুরসভার বাধা কোথায়? আর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তো নির্দিষ্ট করে দেশের সব পৌরসংস্থাকে পুরনো পাঁচশো এবং হাজার টাকার নোট ব্যবহারের ক্ষমতা দিয়েছে। কোথাও তো বলা নেই কত টাকা পর্যন্ত নেওয়া যাবে।’’
তা হলে ভিড় কেন? পুরসভার এক আধিকারিক জানান, বকেয়া করদাতাদের জন্য পুরসভা একটু সুবিধা করে দিয়েছে পুর আইনের একটি সংশোধন করে। আগে সময়ে কর জমা না পড়লে সম্পত্তি করের সঙ্গে সুদ যোগ হত, যা এক লক্ষ টাকার নীচে হলে মাসে ১ শতাংশ এবং এক লক্ষের বেশি হলে মাসে দেড় শতাংশ। আসলের সঙ্গে সুদ যোগ হয়ে টাকার পরিমাণটা বেশ বেড়ে গিয়েছে বকেয়া করদাতাদের। তিনি জানান, বকেয়া করদাতাদের সুদ ছাড়ের বিষয়টি পুরআইন সংশোধন করে করা হয়েছে। এই ক্ষমতা মেয়র পারিষদ মেয়রের হাতেই দিয়েছে। তাই এক দিকে পাঁচশো এবং হাজার টাকার নোট ব্যবহারের সুযোগ আর তার সঙ্গে সুদের উপর ছাড়, এই দুইয়ের কারণে টাকা জমা দেওয়ার হিড়িক বাড়ছে বলে ওই অফিসারের দাবি। এখানেই আপত্তি বিকাশবাবুর। তাঁর বক্তব্য, ‘‘যারা কর বাকি রাখতে অভ্যস্ত, তারা তো অপরাধী। তাদের কেন সুদের ছাড় দেওয়া হবে?’’ প্রকারান্তরে তা কালো পথকেই স্বীকৃতি দেওয়ার সামিল বলে বিকাশবাবুর অভিযোগ।
এই সম্পর্কে পুরসভার এক আমলা বলেন, ‘‘এমন ভাবার কোনও কারণ নেই যে কালো টাকা সাদা করার জন্য সম্পত্তিকর দিলেই ছাড় মিলবে। কে কত টাকা পুরসভায় জমা দিচ্ছেন তার তো রসিদ দেয় পুরসভা। আর তা সহজেই আয়কর দফতরের নজরেও চলে আসতে পারে। তাই সম্পত্তিকর জমা দেওয়ার টাকা কী ভাবে মিলল তা জানা কি আয়কর দফতরের কাছে খুবই কঠিন কাজ হবে?’’
তাঁর ব্যাখ্যা, নোট বিপর্যয়ের পর কালো টাকার কারবারিরা প্রথমেই পরামর্শ নিয়েছে নিজেদের চাটার্ড অ্যাকাউন্ট ফার্মের কাছে। কেউ সোনা কেনার, কেউ ধর্মীয় সংস্থায় টাকা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। পুরসভায় সম্পত্তিকর মেটানোর পরামর্শ কোনও কালো টাকার কারবারি নিয়েছেন বলে মনে করেন না ওই অফিসার।
আরও একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে পুরসভার অভ্যন্তরে। তা হল, সম্পত্তি করের ক্ষেত্রে নগদে ২৫ হাজারের বেশি টাকা এক বারে নেওয়ার নিয়ম নেই পুরসভায়। ২০১২ সালে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের আমলেই সেই নিয়ম করা হয়েছে। নগদ জমা নেওয়ার উর্ধসীমা ২৫ হাজার। তার বেশি হলে ড্রাফটে দিতে হবে। তা জেনেও মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও জোর গলায় বলছেন, এক বারে ২৫ হাজারের বেশি টাকা তো নেওয়া হচ্ছে না।
তা হলে লক্ষ লক্ষ টাকা পুরসভা নগদে জমা নিচ্ছে কী ভাবে?
বিষয়টা খোলসা হলো পুরসভারই এক আমলার কথায়। তিনি জানান, পুর প্রশাসনের কর আদায়ের যে সফটওয়্যার রয়েছে তা একবারে ২৫ হাজারের বেশি গ্রহণ করবেই না। তা হলে? তিনি জানান, কারও এক লক্ষ টাকা বাকি রয়েছে। তার ক্ষেত্রে চার বারে নেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু সে ক্ষেত্রেও তো নিয়ম ভাঙা হচ্ছে। ওই আমলা তা স্বীকার করে বলেন, ২৫ হাজারের বেশি হলে নিয়ম হল ড্রাফ্টে টাকা মেটানো। এখন ব্যাঙ্কগুলোর যে অবস্থা, তাতে ড্রাফ্ট করানোর প্রক্রিয়া তো বন্ধই হয়ে রয়েছে। এক ঘণ্টায় যা মিলত, এখন ১০ দিনেও তা মিলছে না। তাই ড্রাফ্ট করাতে গেলে তো সম্পত্তি করই নেওয়া যাবে না। পুরসভার আয় বাড়াতে এখন কর মূল্যায়ন দফতরের আধিকারিকেরাও বকেয়া করদাতাদের কর মেটানোর অনুরোধ করছেন টেলিফোনে, সাক্ষাতে। তাতেও সুফল মিলছে বলে পুর প্রশাসনের দাবি। প্রশ্ন উঠছে পুরসভার এত আগ্রহ কেন?
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া কী এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে?
মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সাফ জবাব, ‘‘যা কিছু করছি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশ মেনেই। পাঁচশো এবং হাজার টাকার নোট গ্রহণের অনুমতি তো সেখান থেকেই এসেছে।’’