চিচিং ফাঁক: এমন প্যাডের জোরেই নিয়ম ভেঙে চলে লরি।
রাতভর তাঁদের ঘুম থাকে না। যেখানেই থাকুন, সর্বক্ষণ চোখ রাখতে হয় চার-পাঁচটা মোবাইল ফোনে। হাতের কাছেই রাখতে হয় কাগজ-কলম! কারণ, তাঁরাই এ শহরে লরির ‘গেট পাস’! একের পর এক লরির চালক অবস্থান জানিয়ে ফোন করবেন, আর কাগজ-কলমে হিসেব রেখে এই ‘প্যাড পার্টি’রা তৈরি করবেন লরির ‘গ্রিন করিডর’!
যে করিডরে পুলিশ ধরবে না। নিয়ম ভেঙে অতিরিক্ত ওজন বহন বা সিগন্যাল ভাঙার মামলা হবে না। চালক মত্ত কি না, কেউ জানতে চাইবেন না। বিপত্তি ঘটালেও মমলা-মোকদ্দমা হবে না! এমনকি, কাউকে পিষে মারলেও সহজেই আত্মগোপন করতে পারবেন লরির চালক। সবটাই দেখে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে, তাঁরাই আবার মোবাইল বার্তা পাঠিয়ে দেবেন ‘উপরতলায়’!
গত কয়েক বছর ধরে এ ভাবেই লরির দৌরাত্ম্যের রাস্তা করে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। আনলক-পর্বে যা আরও বেড়েছে। আসন্ন বিধানসভা ভোটের আগে এই মুহূর্তে প্যাড পার্টিদের দৌলতেই লরির দৌরাত্ম্য মাত্রাছাড়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। তাঁরা জানাচ্ছেন, এখন আর পুলিশ-বিধি মেনে রাত সাড়ে ১০টার পরে লরি পথে নামে না। রাস্তা তাদের দখলে চলে যায় রাত ন’টাতেই। অন্য গাড়ি দাঁড় করিয়ে সময় ধরে চলা স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল অগ্রাহ্য করে লরির পথ করে দেয় পুলিশই। যে সেতু বা উড়ালপুলে লরি ওঠা নিষিদ্ধ, সেখানেও তাদের অবাধ যাতায়াত। এমনকি, মাস তিনেক আগে বেপরোয়া লরির ধাক্কায় ফুটপাতের বাসগুমটিতে দাঁড়ানো দু’জনের মৃত্যুর পরেও কারও হুঁশ ফেরে না!
উত্তর কলকাতার লরি ইউনিয়নের সদস্য নিমাই কর্মকারের যদিও দাবি, সবটাই চলছে প্যাড পার্টির জোরে। তিনি বলেন, ‘‘মা কালী, মা তারা বা ওঁ লেখা কাগজের প্যাড ছাপানো হয়। গাড়ি পিছু তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকা নিয়ে এই প্যাড কেটে দেওয়া হয়। যে লরিতে প্যাড থাকে, অর্থাৎ যে লরি আগে থেকেই প্যাড পার্টিকে টাকা খাইয়ে রাখে তার সব ছাড়।’’ ক্যানাল ওয়েস্ট রোডের আর এক লরিমালিক বাবলু মণ্ডলের দাবি, ‘‘প্যাড পার্টির সদস্য না হলেও মুশকিল। তখন প্রতি মোড়ে মোড়ে টাকা দিতে হবে।’’
লরি মালিক সংগঠনগুলির দাবি, প্যাড পার্টির নামে হাতে লাঠি দিয়ে হাইওয়েতে মোড়ে মোড়ে লোক দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আসানসোল, দুর্গাপুর, বর্ধমান বা কোলাঘাট হয়ে যে সব লরি কলকাতায় ঢুকবে তাদের ধরার জন্য আলাদা প্যাড পার্টি থাকছে ডানলপে। কোনও ভাবে শহরে ঢুকে পড়লেও নিস্তার নেই। রাতের কলকাতায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে প্যাড পার্টি লোক! নিয়ম হল, সঙ্গে প্যাড থাকলে ফোন করে দিতে হয়। কাগজে লিখে রেখে প্যাড পার্টির লোক রাস্তা সাফ করিয়ে দেন। কেউ ধরে না। প্যাড না থাকলেই মোড়ে মোড়ে গাড়ি পিছু দিতে হয় পাঁচশো থেকে হাজার টাকা।
এর সঙ্গেই রয়েছে আরও একটি প্যাকেজ। নাম ‘এমভিআই কার্ড’! তারাতলার লরি ইউনিয়নের নেতা সুন্দর সিংহের দাবি, ‘‘পরিবহণ দফতরের নাম করে কিছু লোক এই কাজ চালাচ্ছে। কার্ড থাকলে নির্দ্বিধায় ওভারওয়েট লরি নিয়ে দাপটের সঙ্গে শহরে ঢুকে পড়া যায়। এই কার্ডের দাদারা সারা রাত জেগে থাকেন। তাঁদের লোক মোটরবাইক নিয়ে রাস্তায় ঘোরেন। ধরপাকড় তো নয়ই, এই কার্ডের প্যাকেজ থাকলে দুর্ঘটনাগ্রস্ত লরিও সরিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য পাওয়া যায়।’’
এমন ব্যাপার পরিবহণ দফতর জানে? ওই দফতরের কেউই এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাননি। বেলতলা আরটিও-র এক আধিকারিক শুধু বলেছেন, ‘‘আগের পরিবহণমন্ত্রী কিছু অভিযোগ পেয়েছিলেন। ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেওছিলেন। বাকিটা পুলিশ বলতে পারবে।’’ কলকাতা পুলিশের শীর্ষ কর্তা অনুজ শর্মাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। শুধু জানিয়েছেন, এটা শুধু কলকাতার ব্যাপার নয়, অভিযোগ থাকলে খতিয়ে দেখা হবে।
‘ফেডারেশন অব ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রাক অপারেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের’ সম্পাদক সজল ঘোষের যদিও দাবি, ‘‘সকলেই সব জানেন। ওভারওয়েটে লরি কেউ ধরে না, ওই এমভিআই কার্ড বা প্যাড পার্টিকে টাকা খাওয়ানো থাকায়। এ রোগ সারাতে না পারলে, পুলিশ-প্রশাসন পথের বিপদ কমাতে পারবে তো? নাকি, প্যাড পার্টির গেট পাসে শহরে লরির দাপট চলছে-চলবে!’’
এ প্রশ্নের অবশ্য স্পষ্ট উত্তর মেলেনি কোনও তরফেই।