ছুটার আমেজ।—ছবি পিটিআই
‘ধর্মঘটের শহর’ উজিয়ে পার্ক সার্কাসের মঞ্চে জড়ো হয়েছে ভিড়টা। ভেসে আসছে আজাদির প্রতিবাদী স্লোগান। সেখান থেকে এ বার উঁকি দিচ্ছে অন্য একটি প্রশ্নও। প্রতিবাদের অন্য রকম ভাষার উপযোগিতা তো ইতিমধ্যেই টের পাওয়া গিয়েছে। এর পরেও চিরকেলে ধর্মঘটের রাজনীতির কি আদৌ কোনও উপযোগিতা রয়েছে?
বুধবারের বিকেলে ধর্মঘটের খবর দেখতে দেখতেই কথা বলছিলেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বলছিলেন, দিল্লির শাহিনবাগের প্রতিবাদের কথা। ‘‘শান্তিপূর্ণ কিন্তু দৃঢ়, নম্র ভাবে প্রতিবাদ যে করা সম্ভব, তা তো শাহিনবাগ আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরেছে। এর থেকে শিক্ষা নিয়েই আমাদের প্রতিবাদের ভাষা ঠিক করা উচিত।’’— বললেন তিনি। শীর্ষেন্দুবাবুর মতে, ‘‘একদা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ধর্মঘটের গুরুত্ব থাকলেও তা এখন অনেকটাই ভোঁতা। যে কোনও ধর্মঘটই আংশিক সফল বা ব্যর্থ হয়। সরকারের আসলে কিছু যায়-আসে না। কিন্তু ভোগান্তি টের পান দিন আনা-দিন খাওয়া মানুষজন।’’
অর্থনীতির বেহাল দশা, কর্মসংস্থানের অভাব থেকে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) বা নয়া নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) বিরোধিতা এ দিন ধর্মঘটে টেনে এনেছিল কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে। সিপিএম, কংগ্রেসের মতো দলগুলিও বাংলায় সেই ধর্মঘটের ডাকেই সওয়ার হয়ে গিয়েছে। এ যাবৎ নাগরিকত্ব আইন বিরোধী প্রতিবাদ বা জামিয়া-আলিগড়-জেএনইউয়ে সন্ত্রাসের প্রতিবাদে বিজেপি-বিরোধী দলগুলি এককাট্টা হলেও এই দেশ জুড়ে ধর্মঘটের সমর্থন ঘিরে ফাটল দেখা দিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে। এবং এর সূত্র ধরেই ফের মাথা চাড়া দিচ্ছে ধর্মঘটের প্রতিবাদ বা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে এর উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন।
ধর্মঘটে নাগরিকদের একাংশের ভোগান্তির দিকটা অস্বীকার করছেন না আইনজীবী-রাজনীতিবিদ অরুণাভ ঘোষ। তবে পাশাপাশি তিনি মনে করাচ্ছেন, রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে এই পন্থা এখনও শুধু এ দেশে নয়, দুনিয়া জুড়েই জারি রয়েছে।
সমাজতন্ত্রী চিনের শাসনে বজ্রনিগড়েও ধর্মঘটের আন্দোলন পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। ফ্রান্সে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা বাস ধর্মঘট এই মুহূর্তে বিশ্ব জুড়ে রীতিমতো চর্চার বিষয়। বিচারকের অভাব মেটাতে ২০১৮-এ আইনজীবীদের ৬৯ দিনের ধর্মঘটে শামিল হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে অরুণাভবাবুর। তাতে কত দূর লাভ বা ক্ষতি হয়েছে মানুষের, সেটা অবশ্যই জল্পনার বিষয়। অরুণাভবাবু বলছেন, ‘‘ধর্মঘটের মধ্যে এক ধরনের স্বার্থপরতা আছে। অবশ্যই কিছু মানুষকে ভুগতে হয়। কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কখনও কখনও ধর্মঘটের পন্থা কাজেও আসে। শিল্প-বিরোধ আইনেও ধর্মঘট কিন্তু আইনি হাতিয়ার।’’ এই ধর্মঘট তত সফল না-হলেও লোকে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছে— পর্যবেক্ষণ তাঁর।
রাজ্যের শাসক দলের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও ধর্মঘটের অস্ত্রকে তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্লেষণ করছেন। ‘‘ধর্মঘট দু’ধরনের— রাজনৈতিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত। স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘটে মানুষই ঠিক করেন, কী করবেন। অন্যটা চাপানো। ক্লাইভের আমল থেকে চালু, ক্লিশে!’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবাদ বা প্রচার নানা ভাবে করা যায়। এ বারের ধর্মঘট যাঁরা ডাকলেন, তাঁরা প্রতিবাদকে বাড়ি-বাড়ি ছড়াতে পারতেন! তা না করে চটজলদি সাফল্য পেতে ধর্মঘটের রাস্তা সঙ্কীর্ণ রাজনীতি।’’ এ দিনের ধর্মঘটের সমর্থকেরা কেউ কেউ মনে করেন, রাজ্য সরকারের কারণে-অকারণে ছুটি দেওয়ার হিড়িকে বরং বেশি কাজ নষ্ট হয়।
প্রতিবাদের যে নানা ভাষা হয়, মানছেন সাহিত্যিক বাণী বসুও। এই মুহূর্তে ভারত জুড়ে নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে পথে নামার নৈতিক দিকটাও তিনি মনে করাচ্ছেন। নানা ভাবে প্রতিবাদ জারি রাখলেও একসঙ্গে গোটা দেশ প্রতিবাদে পথে নামার মধ্যে বিশেষ তাৎপর্য খুঁজে পাচ্ছেন তিনি।