—প্রতীকী চিত্র।
অজ পাড়া-গাঁ নয়, ঝাঁ-চকচকে শহর। আপাতত সেই শহরই ত্রস্ত সাপের উপদ্রবে। চন্দ্রবোড়া, কালাচ-সহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপ কখনও ঢুকে পড়ছে বহুতল আবাসনে, কখনও অফিসে। এ ছবি কলকাতা লাগোয়া নিউ টাউনের। সম্প্রতি সাপের কামড়ে সেখানে মৃত্যু হয়েছে এক পড়ুয়ার। আর সেই ঘটনা নাগরিক-আতঙ্ককে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
নিউ টাউন কলকাতা ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (এনকেডিএ) জানাচ্ছে, তারা সাপের উপদ্রব ঠেকাতে বিভিন্ন এলাকায় কার্বলিক অ্যাসিড ছড়াচ্ছে। সতর্ক করা হয়েছে বন দফতরকেও। তবে অভিযোগ, সাপে কাটার চিকিৎসার সরকারি পরিকাঠামো নিউ টাউনে কিছুই প্রায় নেই। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ বাসিন্দারাও। তাঁদের অভিযোগ, বেসরকারি হাসপাতালেও ওই পরিষেবা পেতে হলে অনেক দূরে যেতে হয়। ততক্ষণে রোগীর অবস্থা সঙ্কটজনক হয়ে পড়ে।
অতি সম্প্রতি নিউ টাউনে ভরসন্ধ্যায় সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়েছে ভিন্ রাজ্য থেকে পরীক্ষা দিতে আসা এক ছাত্রের। তিনি রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়ে তাঁকে সাপে কামড়ায়। অভিযোগ, উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় সময় মতো ওই ছাত্রের চিকিৎসা শুরু করা যায়নি। তাঁকে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলেও তিনি শেষ পর্যন্ত বাঁচেননি।
নিউ টাউনের বাসিন্দা, চিকিৎসক অরুণাংশু চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে সাপের উপদ্রবে আতঙ্কিত বাসিন্দারা নিজেদের মতো করে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখছেন। যেমন, তাঁদের আবাসনে মাসখানেক ধরে অ্যান্টি ভেনামের ভায়াল ও আনুষঙ্গিক ওষুধ রাখা হচ্ছে। যাতে কাউকে সাপে কাটলে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা যায়। তবে এই পরিষেবা শুধু ওই আবাসনের বাসিন্দাদের জন্যই।
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের তরফে যাঁরা সাপ ধরেন তাঁরা জানাচ্ছেন, নিউ টাউন থেকে সপ্তাহে তিন-চারটি ফোন তাঁদের কাছে আসে। সবই আবাসন কিংবা অফিসে সাপ ঢুকে পড়ার খবর। সংগঠনের এক সদস্য আদিত্য রায় বলেন, ‘‘সাপগুলিকে যাতে মেরে ফেলা না হয়, তাই খবর পেলেই আমরা উদ্ধার করতে ছুটি। নিউ টাউনে ফাঁকা মাঠ, জলাজমিতে বসতি তৈরি হওয়ায় তার প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্রে।’’ বিজ্ঞান মঞ্চই জানাচ্ছে, নিউ টাউনে সব চেয়ে বেশি রয়েছে চন্দ্রবোড়া। তার পরেই কালাচ। কালাচ কামড়ালে টের পাওয়া যায় না। কিন্তু তার বিষ সহজে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তাই দ্রুত চিকিৎসা শুরু না করা গেলে রোগী সঙ্কটজনক হয়ে পড়েন।
কমিউনিটি মেডিসিনের চিকিৎসক পলাশ দাসের কথায়, ‘‘শহরের সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অ্যান্টি ভেনাম থাকে। শুধু জানতে হবে, ঘটনাস্থল থেকে কোনটি সব চেয়ে কাছে। যাঁকে সাপে কেটেছে তিনি না জানতেই পারেন, কিন্তু তাঁকে ঠিক পরামর্শ দেওয়ার জন্য সমাজের প্রতি স্তরে এই সচেতনতার প্রসারে জোর দেওয়া উচিত।’’
শহর নিউ টাউনে এনকেডিএ-র অধীনে রয়েছে একাধিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। আবার, নিউ টাউন বিধানসভার অন্তর্গত রেকজোয়ানিতে রয়েছে ব্লকের গ্রামীণ হাসপাতাল এবং চাঁদপুর ও পাথরঘাটায় রয়েছে দু’টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সেখানের চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, অতি বিষধর সাপ কামড়ালে তাঁরা প্রাথমিক ভাবে অ্যান্টি ভেনাম দিয়ে রোগীকে কলকাতার হাসপাতালে পাঠান। কারণ, সাপে কাটার উন্নত চিকিৎসা গ্রামীণ হাসপাতালে থাকে না। এনকেডিএ-র এক শীর্ষ আধিকারিকের দাবি, ‘‘চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সাপে কামড়ানোর চিকিৎসায় উন্নত পরিকাঠামো, অপারেশন থিয়েটার প্রয়োজন। সেই সরকারি পরিকাঠামো এখানে নেই। কর্মীদের বলেছি, কার্বলিক অ্যাসিড ছড়াতে।’’ তিনি জানান, বন দফতরকে বলা হয়েছে সাপের উপদ্রবের খবর এলেই সরঞ্জাম নিয়ে ধরতে যেতে। খবর পেলে এনকেডিএ-র অ্যাম্বুল্যান্সে করে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।
সাপের কামড়ে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা শুরুর কথা বলছেন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইন-চার্জ দয়ালবন্ধু মজুমদারও। তাঁর মতে, ‘‘কলকাতার উপকণ্ঠে সর্পাঘাতে মৃত্যু দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, দশ বছর ধরে সাপের কামড়ের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রত্যন্ত গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও হয়। সেখানে ওই জরুরি চিকিৎসা পেতে কাউকে দীর্ঘ পথ পেরোতে হচ্ছে কেন, তা জানা দরকার। প্রাথমিক শুশ্রূষা স্বাস্থ্যকেন্দ্র না দিলে তার কারণ ব্যাখ্যা করুক স্থানীয় প্রশাসন।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘নিউ টাউনের একাধিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কেন সাপে কাটার প্রাথমিক চিকিৎসা মিলবে না? যেখানে গোসাবা, বেলপাহাড়ির মতো এলাকাতেও তা মেলে? তবে কি ধরতে হবে, সাপে কাটার প্রাথমিক চিকিৎসায় গোসাবার থেকেও পিছিয়ে নিউ টাউন?’’