Building Tilts in Kolkata

হেলে পড়া দুই বহুতলের বিপরীতেই বেআইনি বহুতল

বেআইনি নির্মাণে ছেয়ে গিয়েছে এলাকা। পুরসভা তবু ‘নিষ্ক্রিয়’। ঘুরে দেখল আনন্দবাজার।

Advertisement

মেহবুব কাদের চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ ০৭:১৫
Share:

প্রশ্নচিহ্ন: ক্রিস্টোফার রোডের হেলে পড়া বাড়ির উল্টো দিকে নির্মীয়মাণ বহুতল নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। শনিবার, ট্যাংরায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

১১/২ ক্রিস্টোফার রোড। ট্যাংরার এই তল্লাটে কয়েক হাজার বাড়ির ঠিকানা একই। পুরো এলাকাই যেন বেআইনি নির্মাণের কারখানা!

Advertisement

উপরের ঠিকানাটি বস্তি এলাকার অন্তর্গত। সেই ঠিকানাতেই ছ’তলা উঁচু দু’টি বেআইনি বাড়ি পরস্পরের উপরে হেলে পড়েছে অত্যন্ত বিপজ্জনক ভাবে। সেই ছবি বুধবার প্রকাশ্যে আসতেই গোটা শহরে শোরগোল পড়ে যায়। ঘটনাস্থলে গিয়ে এবং আশপাশের এলাকায় ঢুঁ মেরে জানা যায়, সেখানকার বেশির ভাগ বহুতলই বেআইনি ভাবে তৈরি করা হয়েছে। পুরসভার কোনও নিয়মকানুন যে সেখানে মানা হয় না, তার প্রমাণও মিলল একেবারে হাতেনাতে! যে দু‌’টি বহুতল হেলে পড়েছে, ঠিক তার উল্টো দিকেই তৈরি হচ্ছে পাঁচতলা একটি বহুতল। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বেশি মাত্রায় হেলে পড়া বেআইনি বহুতলটির প্রোমোটার রজত লি-ই উল্টো দিকের বহুতলটি তৈরি করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘ছ’তলা হেলে পড়া বহুতল নিয়ে এলাকা সরগরম হওয়ার পরেই উল্টো দিকের নির্মীয়মাণ প্রকল্পের যাবতীয় কাজ বন্ধ করে পালিয়ে গিয়েছেন নির্মাণকর্মীরা।’’ ওই বহুতলটিও পুরসভার অনুমোদন ছাড়াই তৈরি হচ্ছিল বলে পুরসভা সূত্রেই খবর। রজত ওই এলাকার একাধিক নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত। অভিযোগ, যার বেশির ভাগই বেআইনি।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, সেখানে বেশির ভাগ নির্মাণে পুরসভারবিল্ডিং দফতর ‘জি প্লাস টু’র (গ্যারাজের উপরে দোতলা) অনুমোদন দিলেও অন্তত পাঁচতলা পর্যন্ত উঠে যায় অবলীলায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক তৃণমূল কর্মীই কোনও রাখঢাক না করে বললেন, ‘‘এই এলাকায় প্রোমোটিং শিল্পের চেহারা নিয়েছে। আর সবেরই ভাগ যায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের পকেটে। যাঁরা ফ্ল্যাট কেনেন, তাঁদের কপালে জোটে যন্ত্রণা আর হতাশা। যেমনটা ঘটল হেলে পড়া বহুতলের আবাসিকদের ক্ষেত্রে। ওঁরা সর্বস্বান্ত হন। আর একদল অসৎ লোকের পকেট ভরে।’’

Advertisement

হেলে পড়া বহুতলের দুই প্রোমোটার রজত লি ও সুরজিৎ মান্নার বিরুদ্ধে কলকাতা পুরসভা ট্যাংরা থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে। তাঁদের দু’জনের বাড়িই ক্রিস্টোফার রোড। অথচ, ঘটনার চার দিন পরেও ট্যাংরা থানার পুলিশ অভিযুক্ত দুই প্রোমোটারকে গ্রেফতার করতে পারেনি। শনিবার রাতে ট্যাংরা থানার এক আধিকারিক বলেন, ‘‘রজত ও সুরজিৎ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।’’

১১/২ ক্রিস্টোফার রোড পুরসভার ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডে। লাগোয়া ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডেও বেআইনি নির্মাণের ভূরি ভূরি অভিযোগ। ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের পটারি রোড বেআইনি নির্মাণে ছেয়ে গিয়েছে বলে জানাচ্ছেন এলাকার বাসিন্দারাই। সরু গলিপথের দু’পাশে ৩২এ পটারি রোড এবং ৩২এফ পটারি রোডে যথাক্রমে একটি চারতলা ও একটি পাঁচতলা বহুতল গজিয়ে উঠেছে। ৩২এ পটারি রোডের চারতলা বহুতলটি পুরসভার ‘জি প্লাস টু’ অনুমোদনপ্রাপ্ত। কিন্তু গড়ে উঠেছে গ্যারাজের উপরে চারতলা। ঠিক উল্টো দিকে পাঁচতলা নির্মীয়মাণ বহুতলেও পুরসভার অনুমোদন ছাড়াই বাড়তি তল যোগ করা হয়েছে। স্থানীয় একটি আবাসন থেকে সকন্যা বেরোচ্ছিলেন এক গৃহবধূ। তাঁরা নিউ টাউন থেকে এসে এখানে ফ্ল্যাট কিনে থাকছেন। হেলে পড়া বাড়ির প্রসঙ্গ উঠতেই মহিলা কার্যত গর্জে উঠলেন, ‘‘কেন যে এখানে এলাম! প্রোমোটার আমাদের যখন ফ্ল্যাটের নকশা দেখিয়েছিলেন, তখন এত সব জানতাম না। এখন তো রীতিমতো ভয় করছে। আবাসনের ভিতরটা ভাল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে চার দিকে এত বহুতল মাথা তুলেছে যে, বাইরে বেরোলেও আকাশটা দেখতে পারি না! বাড়ি হেলে পড়লে যে কী করব, জানি না।’’

৫৮ ও ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের দুই পুরপ্রতিনিধি যথাক্রমে সন্দীপন সাহা ও স্বপন সমাদ্দার। দু’জনেই কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ। ওই দুই ওয়ার্ডে বেআইনি নির্মাণের রমরমা নিয়ে বাসিন্দারা স্থানীয় পুরপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। বাসিন্দাদের সাফ কথা, ‘‘বেআইনি নির্মাণ হলে সরাসরিটাকার ভাগ পান স্থানীয় পুরপ্রতিনিধিরা। কোথায়, কী বেআইনি নির্মাণ হচ্ছে, সে সবের নাড়িনক্ষত্র তাঁদের জানা। তাই ‘জানতাম না’ বলে তাঁরা যে অজুহাত দিচ্ছেন, তা হাস্যকর।’’ ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের পুরপ্রতিনিধি স্বপনকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁর দাবি, ‘‘পটারি রোডে যে বেআইনি নির্মাণগুলি রয়েছে, সেগুলি ২০২১ সালে তৈরি। সেসময়ে আমি ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলাম না।’’ স্বপনের চ্যালেঞ্জ, ‘‘১৯৯৫ সাল থেকে কাউন্সিলর আছি। আমি কোনও ভাবেই বেআইনি নির্মাণে প্রশ্রয় দিই না। কোনও বেআইনি কাজেও মদত দিই না। যে বা যাঁরা এ সব বলছেন, তাঁরা সরাসরি আমাকে বলুন।’’

বাসিন্দাদের অভিযোগ প্রসঙ্গে ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের পুরপ্রতিনিধিসন্দীপনও কার্যত চ্যালেঞ্জের সুরে বলেন, ‘‘বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে দফতর। আমি আইআইএম, জোকা থেকে পাশ করে বিদেশের চাকরি ছেড়ে সৎ ভাবে রাজনীতি করতে এসেছি। কোনও ফড়ে প্রোমোটারের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে নয়। সততাই আমার মূলধন। প্রোমোটারের থেকে টাকার ভাগ পাওয়াটা গল্প ছাড়া কিছু নয়। আমার বিরুদ্ধে কেউ এমন অভিযোগ করতেই পারেন না। যিনি বা যাঁরা অভিযোগ করছেন, সাহস থাকলে সামনে এসে আমার বিরুদ্ধে কথা বলুন।’’

(শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement