নিখোঁজদের সন্ধানে পুলিশের ‘অনাগ্রহ’। প্রতীকী ছবি।
প্রতিদিন গড়ে একটি করে নিখোঁজ ডায়েরি হয়। অধিকাংশেরই খোঁজ মেলে না। কেউ কেউ অবশ্য ফিরেও আসেন। বেশ কিছু দিন কেটে যাওয়ার পরেও খোঁজ না মিললে এবং নিখোঁজের পরিবারের লোকবল থাকলে বিষয়টি সামনে আসে। কোনও ভাবে বিক্ষোভ বা থানা ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটলে কিছু দিন পুলিশি তৎপরতা দেখা যায়। অভিযোগ, তার পরে যে কে সে-ই!
ট্যাংরা, তিলজলা, তপসিয়া, কাশীপুর, আনন্দপুর-সহ বন্দর এলাকার বেশ কিছু থানাতেও নিখোঁজ ডায়েরি ঘিরে এমনই পরিস্থিতি বলে খবর। অভিযোগ, সর্বত্রই চলে এক ধরনের অলিখিত নিয়ম। এই সমস্ত থানায় যে হেতু প্রচুর নিখোঁজ ডায়েরি নথিভুক্ত হয়, তাই দিন চারেক না কাটলে তদন্ত এগোনোই হয় না। দীর্ঘদিন পুলিশে চাকরি করা এক অফিসারই বললেন, “রোজই তো লোক হারায়। অত ভাবলে চলে! কিন্তু কোনও ভাবেই জেনারেল ডায়েরি করার কাজে ফাঁকি দেওয়া চলবে না। যাতে বিতর্ক হলেই কাগজ দেখানো যায়। এর পরে নরমসরম পরিবার দেখলেই ‘দেখুন, ঘুরতে গিয়েছে’ বা ‘অপরাধ করে পালিয়েছে নাকি’ বলে প্রশ্ন ছুড়ে দিতে পারলেই হল।”
অভিযোগ, ট্যাংরায় এক যুবকের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাতেও পুলিশের এমনই ভূমিকা সামনে এসেছে বৃহস্পতিবার। ঝুন্নু রানা নামে ওই যুবক গত ৩ মার্চ থেকে নিখোঁজ থাকলেও পুলিশ নাম-কা-ওয়াস্তে নিখোঁজ ডায়েরি নিয়েছিল বলে স্থানীয়দের দাবি। সেই সঙ্গেই বলে দেওয়া হয়েছিল, সামনে দোল। দোল না মিটলে কিছুই করা যাবে না। প্রায় ১৩ দিন পরেও নিখোঁজ রহস্যের কিনারা হতে না দেখে এর পরে থানা ঘেরাও করেন ঝুন্নুর পরিবারের লোকজন এবং স্থানীয় বাসিন্দারা। ঝুন্নুকে খুন করা হয়েছে বলে তাঁদের দাবি। পুলিশ এই ঘটনায় মোট চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানালেও একাধিক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি শুক্রবারও।
লালবাজারের তরফে কোনও গাফিলতি থাকলে কড়া পদক্ষেপ করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হলেও, সাম্প্রতিক অতীতে একাধিক নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় পুলিশের এমন ভূমিকাই সামনে এসেছে। স্কুলপড়ুয়া ছাত্র বা ছাত্রী নিখোঁজ হলেই থানার দ্বারস্থ হওয়া তাদের পরিবারকে ‘দেখুন, ফুর্তি করতে গিয়েছে’ বলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। বাগুইআটির এমনই এক ছাত্রের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে কিছু দিন আগেই।
বেহালার বাসিন্দা এক পলিটেকনিক পড়ুয়ার নিখোঁজ হওয়া এবং পরে উলুবেড়িয়া থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনায় এখনও রহস্যের কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি নিখোঁজ হওয়ার পরে ওই মাসেরই ২১ তারিখ তাঁর দেহ উদ্ধার হয়। হার্দিক দাস নামে ওই ছাত্রের বাবা হিমাদ্রি জানিয়েছেন, নিখোঁজ হওয়ার দু'ঘণ্টার মধ্যে ডায়েরি করতে যাওয়ায় তা নেওয়া হয়েছে ঠিকই, সঙ্গে বলা হয়েছে, "নিখোঁজ হওয়ার কোনও ঘটনাতেই এত তাড়াতাড়ি ডায়েরি নেওয়া হয় না। মোবাইল ফোনের টাওয়ার লোকেশনও এত দ্রুত দেখা হয় না। এ ক্ষেত্রে করে দেওয়া হল।"
কিন্তু, কেন দ্রুত দেখা হবে না? বেশি সময় দিয়ে অপরাধীর সুবিধা করে দেওয়ার এই প্রবণতা বন্ধ হবে কবে? একই অভিজ্ঞতা কলকাতায় নির্মাণকাজ করতে এসে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মালদহের নজরুল ইসলামের পরিবারের। বেহালার পাঠকপাড়া থেকে নিখোঁজ হওয়া ওই ব্যক্তির সন্ধান এখনও মেলেনি। নজরুলের শ্যালক মহম্মদ খালেক বললেন, "গত ২৬ ডিসেম্বর জামাইবাবু নিখোঁজ হয়ে যান। প্রথমে বেহালা থানায় যাওয়া হলেও পরে পর্ণশ্রী থানায় যেতে বলা হয়। পুলিশ শুধু ‘আজ দেখছি’, ‘কাল দেখছি’, ‘দেখা হবে’ বলে ঘুরিয়েছে। শেষে পুলিশ বলেছে, বেশি টাকার লোভে দেখুন বিদেশে পালিয়েছে। কয়েক বছর পরে ফিরে আসবে।"
তা হলে কি বছরের পর বছর অপেক্ষা করাই ভবিতব্য? একই প্রশ্ন নদিয়ার নিখোঁজ ছাত্র সন্তু ভট্টাচার্যের পরিবারের। ২০১৭ সালে টিউশন নিতে বেরিয়ে নিখোঁজ হওয়া ১৬ বছরের সেই ছাত্রকে খুঁজে দিতে পারেনি সিআইডি। শেষে গত ডিসেম্বরে সিআইডি-র থেকে তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয় কলকাতা হাই কোর্ট। এর পরেও খোঁজ মেলেনি সেই নিখোঁজ ছাত্রের।