মেরামতি: বাঘা যতীন স্টেট জেনারেল হাসপাতালে সংস্কারের কাজ চলছে। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল
যে হাসপাতালে পূর্ত দফতর গত চার-পাঁচ বছর ধরে টানা ভবন সংস্কার আর নির্মাণকাজ চালাচ্ছে, আচমকা সেই ভবনকেই তারা ‘সারানোর অযোগ্য’ বলে কী করে? আর ওই ভবনের অবস্থা যদি এতটাই শোচনীয় হয়, তা হলে স্বাস্থ্য দফতরই বা কী করে সেখানে একের পর এক নতুন ওয়ার্ড ও পরিষেবা চালু করছে? বাঘা যতীন স্টেট জেনারেল হাসপাতালের ‘স্বাস্থ্য’ নিয়ে তাই এমনই রহস্য তৈরি হয়েছে!
দক্ষিণ কলকাতা, দক্ষিণ শহরতলি এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ চিকিৎসার জন্য ওই হাসপাতালের উপরে নির্ভরশীল। পাশাপাশি, ওই হাসপাতাল ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ‘অ্যানেক্স হাসপাতাল’-এর মর্যাদাপ্রাপ্ত। গত চার-পাঁচ বছর ধরে সেখানে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে পুরনো ভবনের সংস্কার, নতুন ভবনের নির্মাণ ও সৌন্দর্যায়নের কাজ হয়ে চলেছে। কিন্তু গত ২৪ ডিসেম্বর হঠাৎ পূর্ত দফতরের কলকাতা সার্কলের তরফে স্বাস্থ্য দফতরকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়— বাঘা যতীন হাসপাতালের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, তা আর সারানোর পর্যায়ে নেই। হাসপাতাল ভবন সংস্কারের অযোগ্য মানে হল, হয় সেটি পাকাপাকি ভাবে বন্ধ করে দেওয়া। না হলে পরিষেবা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে স্থানীয় বাসিন্দা, বিধায়ক বা কাউন্সিলর— প্রত্যেকেরই প্রশ্ন, তা হলে এত দিন ধরে বিপুল টাকা খরচ করে কী ধরনের সংস্কারের কাজ চলল? দ্বিতীয়ত, হাসপাতালের হাল যখন এতই খারাপ, তখন গত কয়েক বছরে নতুন ওয়ার্ড, জলাধার, অফিস, মেল নার্সিং কলেজ ও হস্টেল, অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা, আয়ুষ অফিস, এইচডিইউ, লেবার ওয়ার্ড, ওটি কমপ্লেক্স তৈরি করা হল কেন?
প্রকৃত অবস্থা জানতে গত ২৭ জানুয়ারি স্বাস্থ্য দফতরের প্রতিনিধি ও স্থানীয় কাউন্সিলরের উপস্থিতিতে বৈঠকও হয়। তাতেও সমাধান বেরোয়নি। ঠিক হয়েছে, কোনও আন্তর্জাতিক মানের সংস্থাকে দিয়ে হাসপাতাল ভবনের অবস্থা পরীক্ষা করিয়ে সেই রিপোর্ট স্বাস্থ্য ভবনে জমা দেওয়া হবে। তার পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
এলাকার কাউন্সিলর দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘হাসপাতালের সংস্কারে গত কয়েক বছরে সাত কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। ভবনের স্তম্ভগুলির ক্ষয় রুখতে সম্প্রতি ৬০ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। তার পরেও কেন হাসপাতালের হাল এত খারাপ হবে? আমাদের সন্দেহ, এর মধ্যে অন্য কোনও গল্প রয়েছে।’’
বাঘা যতীন হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত, পূর্ত দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার তাপস দত্তচৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘এত দিন শুধু ভবনের গঠনগত সারাইয়ের কাজ হয়েছে। হাসপাতাল সচল রাখতে ঠেকনা দেওয়া হয়েছে। সে ভাবে সংস্কার বা ‘ডিসট্রেস রিপেয়ার’ হয়নি। কিছু দিন আগে আমরা যখন হাসপাতাল ভবনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলাম, তাতে দেখা গেল, আর সারিয়েও কিছু হবে না।’’
প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে আরও আগে এই স্বাস্থ্য পরীক্ষা হল না কেন? তাপসবাবুর জবাব, ‘‘তিন বছর আগে এই পরীক্ষা হলে তখনও প্রশ্ন উঠত, আরও আগে কেন হল না।’’ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ বা আর জি করের মতো হাসপাতাল বয়সে অনেক প্রাচীন। সেই সব ভবন যখন রক্ষা করা যাচ্ছে, তখন বয়সে অনেক নবীন বাঘা যতীনের এত অবনতি হল কী করে? তাপসবাবু বলেন, ‘‘হ্যাঁ, এর অবস্থা বেশি খারাপ।’’ স্বাস্থ্য-অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘যদি প্রমাণিত হয়, ভবনের অবস্থা সত্যিই খারাপ, তা হলে তো ঝুঁকি নেওয়া যায় না। কিছু সময়ের জন্য রোগী, চিকিৎসক, নার্সদের অন্যত্র পাঠানো হবে। হাসপাতাল পাকাপাকি বন্ধের প্রশ্ন উঠছে না।’’
এলাকার বাম বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ ব্যাপারে চিঠি দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বহু মানুষ এই হাসপাতালের উপরে নির্ভরশীল। মুখ্যমন্ত্রীও এর জন্য অনেক টাকা খরচ করছেন। আমি তাঁকে জানিয়েছি, কেউ স্রেফ টাকা রোজগারের জন্য তৈরি ভবন আবার ভাঙতে চাইছে না তো? তা হলে এত দিন ওখানে কী কাজ হল? উনি যেন একটু খতিয়ে দেখেন এবং হাসপাতালের পরিষেবা অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করেন।’’