উচ্ছ্বাস: দিল্লির ভোটের ফলাফলে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী আন্দোলনকারীরা উজ্জীবিত। মঙ্গলবার রাতে তারই ঝলক (বাঁ দিকে) খিদিরপুর, (ডান দিকে উপরে) পার্ক সার্কাস ও (ডান দিকে নীচে) রাজাবাজারে। নিজস্ব চিত্র
বাংলায় বা হিন্দিতে স্লোগানে ফিরে ফিরে আসছে শাহিন বাগের নাম। কে বলবে ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টার ঘরে ঢুকে পড়েছে!
খিদিরপুরের নবাব আলি পার্কের মাঠ তখনও তালে তালে নাচছে, ‘তিওয়ারি ঠাকুর হেরে গেল / শাহিন বাগ জিতে গেল! মোদী ভি হার গয়া / শাহিন বাগ জিত গয়া!’ কিংবা ‘বিজেপি হার গয়া / শাহিন বাগ জিত গয়া’! ধিক্কারের নিশানায় দিল্লির বিজেপি সভাপতি মনোজ তিওয়ারি থেকে গুলি করার হুমকিখ্যাত মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর! স্লোগানের জবাবে জনতার সমস্বরে শাহিন বাগের জয়ের ঘোষণাই গর্জে উঠছে।
রাজাবাজার থেকে পার্ক সার্কাস বা খিদিরপুর— মঙ্গলবার রাতের যেন অন্য রং। দিল্লিতে মর্যাদার ভোট যুদ্ধে বিজেপি-র গোহারান হারের পরে কলকাতার সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদের খাস উঠোনেও দ্বিগুণ উত্তেজনায় প্রাণসঞ্চার হল।
প্রবল প্রতিপক্ষ আপকে গদিচ্যুত করতে শাহিন বাগের সংবিধান রক্ষার অবস্থানকেই নোংরা রাজনীতির তাস হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল বিজেপি। ভোটপ্রচারে অমিত শাহের ‘বিখ্যাত’ বক্তৃতা, শাহিন বাগকে কাঁপুনি ধরাতে ‘জোর সে’ ভোটযন্ত্রে বোতাম টেপার ডাক তিরের মতো বিঁধছিল পার্ক সার্কাস, রাজাবাজার বা খিদিরপুরকেও। ক্লাস সিক্সের খুদে মেয়ে ফলক মিরাজ়ের নিজের লেখা উর্দু কবিতাও প্রশ্ন তুলল, ‘কারেন্ট’টা (কাঁপুনি) তা হলে কোথায় লাগল মোদীজি? রাতের পার্ক সার্কাস তখন সোল্লাসে হাততালিতে ফেটে পড়েছে।
একই সুর শোনা গিয়েছে রাজাবাজারেও। দিল্লির শাহিন বাগের ‘দাদিরা’ কেউ কেউ গোড়ায় গাঁধীর মৌনব্রত পালন করলেও যেমন খুশি চেপে রাখা যায়নি, কলকাতার সংযমের রাশও বেশি ক্ষণ ধরে রাখা গেল না। স্থানীয় মুসাসেঠ মসজিদের মুফতি ইজ়হারুল হকও মনে করালেন, দিল্লির ভোটে অমিত শাহের ‘কারেন্ট-থেরাপি’র তত্ত্ব। এর পরে সুরেলা কণ্ঠের স্বরচিত গজ়ল পরিবেশন। ‘‘মোদী হ্যায় পরেশান অউর যোগী ভি হ্যায় হয়রান / অমিত কি সিয়াসত ভি তড়িপার হো গই (মোদী ক্লান্ত, যোগীও ধ্বস্ত / অমিতের রাজনীতি শহরছাড়া পর্যুদস্ত)। মুফতিসাহেব এ-ও শোনালেন, আগামী দিনের ভারতবর্ষে কী ঘটতে চলেছে। ‘‘হোগা এঁহি বঙ্গাল অউর বিহার অউর ইউপি মে, অব দেশ কি জনতা বিদার হো গই (বাংলা, বিহার, ইউপিতেও এ বার এমনটাই ঘটবে, দেশের জনতা এ বার জেগে উঠেছে)।’’ লোকগানের সুরে সংস্কৃত কলেজের ছাত্র অনিমেষ দত্তের প্যারডি ‘রামের নামে ভোট দিয়ে ফাঁসল জনগণ’ শুনেও রাজাবাজার হাসিতে ফেটে পড়েছে।
খিদিরপুরে মধ্যরাতেও ছোট ব্যবসায়ী গার্ডেনরিচের বাঁধাবটতলার ‘লাল্টুদা’ ওরফে ফজ়লুল হক গাজ়ির কথা শুনছে ভিড়টা। লাল্টু বাংলায় বলছিলেন, ‘‘এই যে কথায় কথায় রামের নাম করে বিজেপি দিল্লিতে ভোটটা লড়ল, তাতে লাভটা কী হল? রামচন্দ্র মহান লোক ছিলেন। তিনি ভরতকে রাজ্য ছেড়ে চলে যান, রাম কি কখনও শেখাতে পারেন, জামিয়ায় মেয়েদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে?’’ অরবিন্দ কেজরীবাল কী ভাবে বাড়ির বড় ছেলের মতো বিজলি-পানির দরকারে সবার পাশে থাকার কথা বলেছিলেন, ‘লাল্টুদার’ মুখে সে সব শুনে জনতা আহ্লাদে আটখানা।
পার্ক সার্কাসের মাঠে নিয়মিত মুখ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান-সমাজতত্ত্বে গবেষণারত নওশিন বাবা খান বা পার্ক সার্কাসের তরুণ ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ আসাদেরা বলছিলেন, ‘‘দিল্লির জয় আপাত ভাবে দলীয় রাজনীতির বিষয়। শাহিন বাগ বা পার্ক সার্কাসের আন্দোলন দলীয় রাজনীতির থেকে অনেক বড় লড়াই, সংবিধান রক্ষার ডাক। কিন্তু বিজেপি-র বিরুদ্ধে প্রতিটা ভোটই আসলে দেশের হয়ে ভোট। তাই খুশির যথেষ্ট কারণ আছে।’’ খিদিরপুরে সদ্য কলেজ পাশ তরুণী মেহউইশ খান, ডাক্তারবাবু সঞ্জয়কুমার গুপ্ত, ফাদার রডনি বোর্নিয়ো, বিশ্বজিৎ লালা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নবমিতা, রূপকথারা রাত পর্যন্ত মাঠ মাতিয়ে রেখেছেন। ইএম বাইপাসের রুবি মোড়ের বাসিন্দা নবমিতার কথায়, ‘‘গোড়ায় পার্ক সার্কাসে আসতাম, এখন দেখছি ধর্মের নামে বিভাজন নিয়ে শহরের নানা জায়গাতেই সচেতনতা বাড়ছে।’’ দিল্লির ভোট কলকাতাকে বাড়তি অক্সিজেন দিয়ে গেল।