সাহায্য: ত্রাণ নিতে এসেছেন দৃষ্টিহীনেরা নিজস্ব চিত্র
তাঁরা কেউ রেলস্টেশনে হরেক রকম জিনিস বিক্রি করেন। কেউ আবার ট্রেনের কামরায় গান গেয়ে উপার্জন করেন। বর্তমান অতিমারি পরিস্থিতি এবং সরকারি বিধিনিষেধের এই কঠিন সময়ে কেমন আছেন আর্থিক ভাবে দুর্বল সেই সব দৃষ্টিহীন মানুষেরা? তাঁদের খোঁজ নিতে এবং ত্রাণ দিতে এ বার দুই সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে পথে নেমেছেন নরেন্দ্রপুরের রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ বিশ্বজিৎ ঘোষ। তাঁর কথায়, “আমি নিজে এক জন দৃষ্টিহীন। তাই হয়তো একটু বেশিই বুঝি, করোনা, লকডাউন আর সরকারি কড়াকড়ির এই কঠিন দিনে দৃষ্টিহীন গরীব মানুষদের জীবন-যন্ত্রণার কথা, ওঁদের অসহায় অবস্থার কথা। তাই সাধ্যমতো ওঁদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতে রাস্তায় বেরিয়েছি।”
আপাতত দু’জন সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে করে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন বিশ্বজিৎবাবু। সঙ্গে রয়েছে ত্রাণের সামগ্রী— চাল, ডাল, কেক, বিস্কুট, স্যানিটাইজ়ার, মাস্ক ইত্যাদি। এ ভাবেই পৌঁছে যাচ্ছেন বেহালা থেকে মোমিনপুর, টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়া-যাদবপুর। বিশ্বজিৎবাবু বলেন, “প্রতিটি এলাকারই আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া কিছু দৃষ্টিহীন মানুষদের ফোন নম্বর-ঠিকানা, তাঁদের পেশা সংক্রান্ত সব তথ্য আমার কাছে রয়েছে। তাই যে দিন যে এলাকায় যাব, তার আগের দিন ফোন করে তাঁদের জানিয়ে দিই, যাতে এলাকার আর্থিক ভাবে দুর্বল দৃষ্টিহীনেরা সেই সময়ে সেখানে চলে আসেন।” এ কাজে তাঁকে সাহায্য করেন তাঁর দুই সহকারী। তাঁরা সঙ্গে থাকলে রাস্তা চিনে কোনও জায়গায় পৌঁছনোর কাজটা সহজ হয়ে যায়।
বিশ্বজিৎবাবু জানান, এই অতিমারি পরিস্থিতি দৃষ্টিহীন মানুষদেরও কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলেছে। সব চেয়ে সমস্যায় রয়েছেন সেই সব দৃষ্টিহীনেরা, যাঁরা এত দিন রেলের প্ল্যাটফর্মে বা ট্রেনের কামরায় গান গেয়ে বা হকার হিসেবে জিনিস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন। কিন্তু সরকারি কড়াকড়ির কারণে ট্রেন বন্ধ থাকায় তাঁদের উপার্জনের সেই পথ আপাতত বন্ধ। বিশ্বজিৎবাবুর মতে, করোনা এবং সরকারি বিধিনিষেধের কারণে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য সরকার ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করছে ঠিকই, কিন্তু আরও বেশি মানবিকতার সঙ্গে দৃষ্টিহীনদের কথা ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁর কথায়, “অতিমারি পরিস্থিতিতে বহু দৃষ্টিহীন মানুষের উপার্জন শূন্য হয়ে গিয়েছে। কত জনের কাছেই বা আমরা পৌঁছতে পারছি! তবু পাশে থাকার জন্য প্রতিদিনই ত্রাণ নিয়ে বেরিয়ে পড়ছি।’’
তবে এই কাজে তিনি একা নন। বিশ্বজিৎবাবুকে আর্থিক ভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন অনেকেই। “আমার এই উদ্যোগের কথা শুনে রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমির প্রাক্তন কৃতী ছাত্রেরা, যাঁরা আজ প্রতিষ্ঠিত, তাঁরাও আর্থিক সাহায্য পাঠিয়েছেন। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বেশ কয়েক জন সন্ন্যাসী, এমনকি শহরের একটি চক্ষু হাসপাতালও আর্থিক ভাবে সাহায্য করেছে।”— বলছেন অধ্যক্ষ।
তাই এ বার শুধু কলকাতার গণ্ডির মধ্যেই নয়, শহরতলিতেও ত্রাণ নিয়ে দৃষ্টিহীন মানুষদের দুয়ারে পৌঁছে যেতে চাইছেন বিশ্বজিৎবাবু। তিনি বলছেন, “ব্যারাকপুর, কল্যাণী, কৃষ্ণনগরের দিকেও যাব। ওখান থেকে অনেক দৃষ্টিহীন ফোন করে জানাচ্ছেন যে, তাঁরা খুব অসুবিধার মধ্যে আছেন। ওঁদের মুখে হাসি ফোটাতে আমাকে আবার বেরিয়ে পড়তেই হবে।”