হাবড়ায় গাছ কাটার কাজ করছেন কামারুজ্জামানের সঙ্গীরা। নিজস্ব চিত্র
আকাশ ঢাকা বিশাল শিরীষ গাছের মগডালে বসে তিনি। গাছ কাটা চলছে। কপিকলে মোটা ডাল নামছে মাটিতে। গাছের মাথায় বসেই দেখভাল করছেন মধ্য তিরিশের কামারুজ্জামান মণ্ডল। চার ফুট ব্যাসের বিশাল শিরীষটাকে ২০ দিনেই কেটে সাফ করে দিলেন তাঁর সঙ্গীরা।
১০ বছর ধরে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা চওড়া করার কাজের জন্য সরকার বাহাদুরের নির্দেশে গাছ কাটছেন বাগজোলার কামারুজ্জামান। দশ জন সহকারী লাগিয়ে ফুট চারেক ব্যাসের শিরীষ গাছ কাটতে লেগে যায় ২০ দিন। আবার, এক দিনে ২০টা মাঝারি গাছও কেটে নামিয়ে দেন কামারুজ্জান। গড়ে প্রতিদিন একটি করে গাছ কাটেন। সেই হিসেবে ১০ বছরে তিনি কেটেছেন ৩৬৫০টি গাছ।
কামারুজ্জামানের সঙ্গে যখন দ্বিতীয় বার কথা হচ্ছে, দিন দশেক পরে তখন হাবড়া-মগরা রোডের (গৌড়বঙ্গ রোড) ‘জোড়া শিরীষতলা’ এলাকায় রাস্তার দু’পাশের দু’টি বিশাল শিরীষ কেটে সাফ করে দিয়েছেন তিনি। এলাকার অবস্থা এমন হয়েছে যে, হঠাৎ গাছ দু’টি গায়েব হয়ে যাওয়ায় নিজের শ্বশুরবাড়িও চিনতে পারছিলেন না হাবড়ার বাসিন্দা প্রান্তিক দে। তাঁর কথায়, ‘‘রাস্তার পাশে জোড়া শিরীষতলায় শ্বশুরবাড়ি। মাসখানেক পরে এলাকায় গিয়ে বিশাল গাছ দু’টি না থাকায় জায়গাটাই চিনতে পারছিলাম না।’’ সেখানে গিয়ে দেখা গেল, এক সময়ে ছায়া ঘেরা এলাকাটিতে এখন চড়া রোদে এক মুহূর্ত দাঁড়ানোর উপায় নেই। গাছ দু’টি না থাকায় ‘জোড়া শিরীষতলা’ নামও হারিয়ে গিয়েছে রাতারাতি।
নিজের এলাকাতেই শুধু গাছ কাটার ‘বরাত’ পান কামারুজ্জামান। দলে রয়েছেন মহম্মদ জুলফিকার আলি মণ্ডল, ফারুক মণ্ডল, গফ্ফুর শেখরা। কেউ গাছ কাটছেন ২২ বছর ধরে, কেউ ১৭ বছর, কেউ বা ৮ বছর। জুলফিকারেরা জানালেন, তাঁদের মতো গোটা জেলায় অসংখ্য গাছ কাটার দল রয়েছে। একটি দল একটি নির্দিষ্ট এলাকায় গাছ কাটার বরাত নেয়। ‘‘প্রচুর গাছ কাটতে হয়, তাই সব দলই প্রতিদিন কোথাও না কোথাও গাছ কাটছে’’— বলছেন গফ্ফুর।
হাবরা-মগরা রোডের ৯ কিলোমিটার রাস্তা সম্প্রসারণ করার কথা পূর্ত দফতরের। সে জন্য দফতর থেকে রাস্তার দু’পাশের প্রায় ২০০ গাছ কাটার ‘টেন্ডার’ নিয়েছেন হাড়োয়ার এক ব্যক্তি। গাছ কাটার বরাত মিলেছে কামারুজ্জামানদের। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গাছ কেটে রোজ মেলে ৩৫০-৪০০ টাকা।
গাছ কাটার পরে সেগুলির গুঁড়ি দেওয়া হচ্ছে মোটরবাইকের ইঞ্জিনে তৈরি কাঠ কাটার মেশিনে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে ছোট ছোট তক্তা। কোনও কোনও ব্যবসায়ী সেখান থেকেই ওই তক্তা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার ক্রেন দিয়ে সেই বিশাল গুঁড়ি কাঠগোলায় নিয়ে যাচ্ছেন কেউ। এক বার মোবাইলে কথা, এক বার তক্তার গুনতি— সবটাই দেখভাল করছেন কামারুজ্জামান।
পড়াশোনা তেমন শেখেননি। বাবার হাত ধরেই গাছ কাটার পেশায় আসা। গাছের যে প্রাণ আছে, জানেন কামারুজ্জামান। তা হলে গাছ কাটা যে অপরাধ, সে কথা জানেন? কিছু ক্ষণ চুপ করে থেকে কামারুজ্জামান বললেন, ‘‘ছেলেকে স্কুলে দিয়েছি। সে এ কাজ করবে না।’’
যদিও বা ‘এ কাজ’ করে, তত দিনে কাটার মতো গাছ আর থাকবে কি— প্রশ্ন এলাকার মানুষেরই।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।