অপেক্ষা: করোনা হয়নি, এমন মৃতদেহ সারি দিয়ে রাখা নিমতলা শ্মশানে। নিজস্ব চিত্র
করোনা মৃতদেহের লাঞ্ছনা, অসম্মান নিয়ে অভিযোগ ওঠে প্রায়ই। কিন্তু করোনায় মৃত্যু হয়নি, এমন কারও দেহ প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছে তো? তাঁদের দেহের সৎকার করতে গিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে না তো? গত কয়েক দিনে মৃত্যু হয়েছে, এমন অনেকের পরিবারেরই অভিযোগ, করোনা পরিস্থিতিতে অন্য রোগের চিকিৎসা পাওয়া যেমন বহু ক্ষেত্রেই কষ্টকর হয়ে উঠেছে, তেমনই হয়রানি পোহাতে হচ্ছে মৃতদেহের সৎকার করতে গিয়েও। অভিযোগ, রাতভর ঘুরে বহু জায়গা থেকেই তাঁদের শুনতে হচ্ছে, “রাতে শুধু কোভিড দেহ যাবে। সকালে আসুন!”
গত সোমবারই যেমন দমদমের বাসিন্দা এক ব্যক্তির মৃত্যু হয় বি টি রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। ওই রোগীকে ভর্তির এক দিনের মধ্যেই মৃত বলে ঘোষণা করে হাসপাতাল। রোগীর পরিবারের দাবি, রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ তাঁদের মৃত্যুর খবর জানানো হয়। চার ঘণ্টা অপেক্ষার পরে রাত ২টো নাগাদ ওই পরিবারকে মৃতদেহ দিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়। এর মধ্যেই ওই পরিবার হাসপাতাল ও দমদম সংলগ্ন এলাকার শ্মশানগুলিতে খোঁজখবর করা শুরু করে। অভিযোগ, প্রায় সব জায়গা থেকেই বলা হয়, রাতে শুধুমাত্র কোভিড মৃতদেহ দাহ করা হচ্ছে। যেখানে দুই ধরনের দেহই সৎকার হচ্ছে, সেখানেও আগে কোভিড মৃতদেহ বেশি গুরুত্ব পাবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।
এর পরে ওই পরিবার সিদ্ধান্ত নেয়, পরের দিন বেলা ১২টার মধ্যে হাসপাতাল থেকে দেহ নেওয়া হবে। মৃতের এক আত্মীয় বলেন, “বেলা ১২টা নাগাদ পৌঁছলেও বেলা ২টো পর্যন্ত কাগজপত্র তৈরির নামে অপেক্ষা করানো হয়। আমাদের রোগী যে ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন, সেখানে গিয়ে আমরা দেখি মৃত্যুর প্রায় ১৬ ঘণ্টা পরেও শয্যাতেই পড়ে তাঁর দেহ!” যদিও ওই হাসপাতালের দাবি, দেহ সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগই ছিল না। কারণ করোনায় মৃতদের দেহে ভর্তি ছিল মর্গ!
একই অভিজ্ঞতা যাদবপুরের আরও এক পরিবারের। তাঁদের রোগী ভর্তি ছিলেন বেহালার একটি হাসপাতালে। তাঁদেরও যত ক্ষণে মৃতদেহ দেওয়া হয়েছে, তত ক্ষণে তাতে পচন ধরে গিয়েছিল বলে অভিযোগ। এ ক্ষেত্রেও হাসপাতাল জানিয়েছে, মর্গে দেহ রাখার আর জায়গা নেই। এক হাসপাতাল কর্মী বলেন, “কোভিড মৃতদেহই সময়ে সৎকার করা যাচ্ছে না! নন-কোভিড নিয়ে ভাবছিই না!”
কলকাতা পুরসভার তরফে অবশ্য রবিবার জানানো হয়েছে, বিষয়টি নিয়ে তাঁরা চিন্তিত। রাতে দেহ নিয়ে যেতে না পেরে অনেকেই হাসপাতালের দ্বারস্থ হচ্ছেন। কোথাও মর্গে রাখার জন্য বাড়তি টাকা নিয়েও দেহ ফেলে রাখা হচ্ছে ওয়ার্ডে অন্য রোগীদের মধ্যে। কোথাও আবার মর্গে রাখার নামে স্রেফ অন্যত্র দেহ সরিয়ে রাখারও অভিযোগ উঠছে। এই পরিস্থিতিতে দ্রুত সমস্যা সমাধানে নির্দেশিকা জারি করার কথাও ভাবছে পুরসভা।
কলকাতা পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য পুর অতীন ঘোষ বলেন, “এ জিনিস যাতে না হয় তার জন্যই কাশী মিত্র ঘাট, কাশীপুরের রামকৃষ্ণ মহাশ্মশান এবং কেওড়াতলা শ্মশানে সর্বক্ষণের জন্য নন-কোভিড মৃতদেহের সৎকার করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গড়িয়া মহাশ্মশান, সিরিটি এবং বিরজুনালা শ্মশান রাখা হয়েছে শুধুমাত্র কোভিড মৃতদেহের জন্য। নিমতলায় কোভিড এবং নন-কোভিড দুই ধরনেরই দেহ দাহ করা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও যদি কোনও শোকাহত পরিবারকে ঘোরানোর অভিযোগ থাকে, আমাদের দ্বারস্থ হলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” সেই সঙ্গে কলকাতায় পৃথক ব্যবস্থা থাকলেও শহরতলির পরিস্থিতি বুঝে সেই দিকেও বাড়তি নজর দেওয়া হবে বলে জানান অতীনবাবু। শ্যামবাজারের বাসিন্দা এক ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য নিমাই ঘোষ অবশ্য বললেন, “দেহ নিয়ে হন্যে হয়ে ঘোরার সময়ে কার কাছে অভিযোগ জানাব? তা ছাড়া, পচন ধরতে থাকা দেহের আগে সৎকার করব, নাকি অভিযোগ?”