রান্নাঘরের ছুরি রাখার স্ট্যান্ডে নেই সবচেয়ে বড় চপারটি। (ডান দিকে) এই শিলেই ঘষে নেওয়া হয়েছিল খুনের অস্ত্রটি। নিজস্ব চিত্র
গরচা রোডের প্রৌঢ়া ঊর্মিলাদেবী ঝুন্ডকে খুন করতে তাঁর বড় বৌমা ডিম্পলের রান্নাঘরের বড় চপারটাই বেছে নিয়েছিল তার প্রেমিক সৌরভ পুরি। যেটি খুনের পর থেকে মিলছে না। সেই দিন দুপুরে ডিম্পলের রান্নাঘরের শিলে সেটি ঘষে নিয়েছিল সৌরভ! তদন্তে নেমে ডিম্পলের ছোট মেয়ের কাছ থেকে এমনই তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। পরে জেরায় ধৃত সৌরভ তা স্বীকারও করেছে।
তদন্তকারীদের সৌরভ আরও জানিয়েছে, খুনের পর সেই চপারটি ব্যাগে ভরে সে রিচি রোডে ডিম্পলের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে। পরদিন সকালে এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে বাইপাসের ধারে এক জায়গায় ফেলে চলে যায় সে। তদন্তকারী অফিসারেরা আপাতত খুনে ব্যবহৃত সেই চপার উদ্ধারের অপেক্ষায়।
জেরায় জানা গিয়েছে, খুনের সময়ে গুড়িয়া যে নাইট সুটটি পরেছিল সেটি ফ্ল্যাটে ফিরে এসে ধুয়ে নেয় সে। আপাতত পুলিশ সেটি বাজেয়াপ্ত করে ফরেন্সিক পরীক্ষায় পাঠিয়েছে। এক তদন্তকারী অফিসার জানিয়েছেন, রাতে বাড়ি এসে সৌরভের রক্ত মাখা প্যান্টটি গুড়িয়া তাদের ফ্ল্যাটের ছাদে নিয়ে গিয়ে মোমবাতি জ্বেলে পুড়িয়ে দেয়। পরদিন তদন্তকারীরা সেখান থেকে ওই পোড়া কাপড়ের নমুনা সংগ্রহ করেছেন।
গোয়েন্দারা ডিম্পলের ছোট মেয়ের কাছ থেকে জেনেছেন, গত ছ’মাস ধরে সৌরভ রিচি রোডের বাড়িতে থাকছিল। পুজোর সময়ে সে পঞ্জাবের নাভায় নিজের বাড়ি ফিরে গেলেও আবার নভেম্বরে ফিরে আসে। গোয়েন্দাদের দাবি, এর পর থেকেই দু’জনে ঊর্মিলাদেবীকে খুনের পরিকল্পনা করে। ঊর্মিলাদেবীর ছোট ছেলে বলরাজ কুমার ঝুন্ড জানিয়েছেন, ডিম্পলের ছোট মেয়ের মানসিক বিকাশ কম। তাই ওকে খুব একটা পাত্তা দিত না ডিম্পল। অথচ সেই মেয়েই তাঁকে জানিয়েছে, শুধু রাতের খাবারে নয়। সারাদিন ধরে ঠাকুরমাকে যে যে খাবার পাঠানো হয়েছিল, তাতে ডিম্পল একটু করে ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছিল। যদিও ছোট ভাইঝি কতটা ঠিক বলছে, তা এখনও স্পষ্ট নয় বলরাজের কাছে।
বুধবার রাতে সে-ও দিদি গুড়িয়ার সঙ্গে গরচা রোড়ে ঠাকুরমার কাছে খাবার নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাকে দিদি ‘‘ভূত আছে’’, বলে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়! সে ভয় পেয়ে বাড়ি চলেও যায়। বোন বাড়ি চলে যেতেই গুড়িয়া ঠাকুরমাকে খেতে দিয়ে পাশের ঘরে অপেক্ষা করতে থাকে। রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ সৌরভ ঢুকলে দু’জনে মিলে ঊর্মিলাদেবীকে খুন করে বেরিয়ে আসে। বেরনোর পরে গুড়িয়া ‘টিক-টক’ ভিডিয়ো তুলে পোস্টও করে।
রবিবার ডিম্পলের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা গেল, সাজানো অ্যাকোয়ারিয়ামের জল ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে। নেতিয়ে পড়েছে মাছও। বলরাজ জানালেন, ডিম্পলের একটি ল্যাব্রাডর ছিল। সেটিকে ছাদের খাঁচায় রাখা থাকত। এ দিনই বলরাজের এক বন্ধু এসে সেটিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। আপাতত তাঁর অন্য পোষ্যদের সঙ্গে সেখানেই থাকবে সে।
এখনও খুনের কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না বলরাজ। রিচি রোডে তাঁর এবং দাদা মনদীপের যৌথ ফ্ল্যাটে (ডিম্পল যে ফ্ল্যাটে থাকতেন) বসে বলরাজ জানান, দাদার মৃত্যুর পরে প্রতি মাসে ৪১ হাজার টাকা বৌদিকে দিতেন শুধু সংসার খরচের জন্য। বাকি গুড়িয়ার পড়াশোনা, চিকিৎসার প্রয়োজনে আলাদা টাকা পাঠাতেন। এমনকি যৌথ ফ্ল্যাটের ঋণের মাসিক কিস্তি ১৫ হাজার টাকাও তিনি দিতেন বলে দাবি করেন বলরাজ। কিন্তু জেরায় তো ডিম্পল পুলিশকে বলেছে যে, ব্যবসার লাভের টাকা আগে স্বামী পেলেও তাকে এখন কম টাকা দেওয়া হত। এমনকি ঊর্মিলাদেবীর সঙ্গে থাকা যৌথ লকারও ডিম্পলকে ব্যবহার করতে দেওয়া হত না।
বলরাজের দাবি, ‘‘মা এবং বৌদির যৌথ লকার যখন, তখন তো নিজে গিয়ে বৌদি সেটি ব্যবহার করতেই পারত। মায়ের তো কিছুই বলার থাকত না।’’ তিনি জানান, দাদা মনদীপ মারা যাওয়ার পর থেকে মা ঊর্মিলাদেবী বড় বৌমা এবং বড় নাতনিকে বেশি ভালবাসতেন। সব সময়ে ডিম্পলকে টাকা দেওয়া থেকে শুরু করে সব রকম সাহায্য করতেন। গুড়িয়ার বিয়েও নিজে দেবেন বলে ঠিক করেছিলেন ঊর্মিলাদেবী।’’
তবে এত প্রশ্নের মাঝে বলরাজকে বেশি করে ভাবাচ্ছে ঠাকুরমাকে খুন করায় গুড়িয়ার প্রত্যক্ষ যোগের কথাটা। তিনি জানান, সব নাতি-নাতনির মধ্যে ঊর্মিলাদেবীর কাছে গুড়িয়াই প্রিয় ছিল। সেই ঠাকুরমাকে কার কথা শুনে, কেন খুন করল, তা এখনও ভাবতে পারছেন না তিনি।
এ দিকে রবিবারই পঞ্জাব থেকে সৌরভকে ট্রানজ়িট রিমান্ডে এনে আলিপুর আদালতে তোলে পুলিশ। সরকারি কৌঁসুলি সৌরীন ঘোষাল জানান, খুনে ব্যবহার করা অস্ত্র উদ্ধার করতে এবং তিন জনকে একসঙ্গে বসিয়ে জেরার জন্য পুলিশি হেফাজতের আবেদন করা হয়। বিচারক সৌরভকেও ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন।