Missing

‘নিখোঁজ মানেই ফুর্তি করছে!’ কবে বদলাবে এমন ধারণা

জেলায় তো বটেই, শহরেও নিখোঁজ ডায়েরি করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় অনেককে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় অভিযোগ নেওয়া হয় না, অথবা তদন্তের নামে দীর্ঘ টালবাহানা চলে।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৬:৫৭
Share:

বুধবার মৃত কিশোর অতনু দে-র ঘরে বসে তার এক আত্মীয়কে জড়িয়ে ধরে কথা বলতে দেখা গেল এক পুলিশকর্তাকে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

পাড়ার মাঠ থেকে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল দমদম গোরাবাজারের বাসিন্দা বছর পনেরোর কিশোর। অভিযোগ, থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করতে যাওয়া বাবা-মাকে পুলিশ বলেছিল, ‘বাড়ি গিয়ে দেখুন, টাকা-গয়না খোয়া গিয়েছে কি না! ছেলে ফুর্তি করতে গিয়েছে।’ এর পর তাঁদের বসিয়ে নিজের তৈরি ‘হিসাব’ বুঝিয়েছিলেন থানার অফিসার ইন-চার্জ। বোঝানো হয়েছিল, দশ বছরের কম বয়স হলে পড়াশোনার কারণে এবং বয়স বারোর কম হলে টাকার লোভে নিখোঁজ ধরতে হবে। পনেরো বা তার বেশি বয়সের ক্ষেত্রে প্রণয়ঘটিত ব্যাপার! আঠারোর আশপাশে হলে বিয়ে বা অন্য কোনও কারণ হতে পারে।

Advertisement

দীর্ঘ বক্তব্যে এই সব শোনালেও ওই অফিসার ইন-চার্জ এফআইআর নিতে চাননি বলে দাবি সেই কিশোরের পরিবারের। বরং তার মা-বাবাকে বলেছিলেন, ‘অভিযোগ করার কী আছে! কয়েক দিন সময় দিন। নিজেই ফিরে আসবে।’ এর চার দিন পরে কিশোরের মৃতদেহ মেলে বাড়ির কাছের খালে। তদন্তে জানা যায়, টাকা হাতাতে বাড়িওয়ালার ওই কিশোর পুত্রকে অপহরণ করেছিল ভাড়াটের ছেলে। ভয় পেয়ে তাকে খুন করে সে।

মঙ্গলবার বাগুইআটি এলাকার এমনই এক ঘটনা শোরগোল ফেলেছে। এ ক্ষেত্রেও নিখোঁজ দুই কিশোরের বাবা-মায়ের উদ্দেশে এমনই ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীদের বড় অংশেরই দাবি, জেলায় তো বটেই, শহরেও নিখোঁজ ডায়েরি করতে গিয়ে একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় অনেককে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় অভিযোগ নেওয়া হয় না, অথবা তদন্তের নামে দীর্ঘ টালবাহানা চলে। বিধাননগর বা রাজ্য পুলিশের কেউই এই অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাননি।

Advertisement

কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার যদিও দাবি, ‘‘এই সব বিষয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। গাফিলতির প্রমাণ মিললেই কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু বাগুইআটির মতো ঘটনা তো রোজ ঘটে না।’’ এই মন্তব্যই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে, এমন ঘটনার ভূরি ভূরি উদাহরণ সত্ত্বেও এই দাবি কতটা ঠিক? এমন ঘটনা যাতে না হয়, সে জন্য থানার স্তরে সংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণের কী ব্যবস্থা হয়? স্পষ্ট উত্তর মেলেনি।

গত জুলাইয়ে বাগুইআটিরই অন্য একটি ঘটনায় সংবেদনশীলতার অভাবের অভিযোগ উঠেছিল। সেখানকার বাসিন্দা বছর উনিশের শৌভিক দেবনাথের নিখোঁজ হওয়ার ডায়েরি করতে বাগুইআটি থানায় যায় তাঁর পরিবার। ৯ জুলাই অভিযোগ নেওয়া হলেও ১৩ জুলাই থানার সামনে অনশনে বসতে হয় শৌভিকের মা সুমিত্রা দেবনাথকে। বুধবার সুমিত্রা বলেন, ‘‘খবরে পড়েছি বাগুইআটির দু’টি ছেলের সঙ্গে কী হয়েছে। আমাদের সঙ্গেও বাগুইআটি থানার পুলিশ একই কাজ করেছে। দিনের পর দিন ঘুরেও পুলিশ কিছু করেনি। নিজেরাই ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। ’’

সুমিত্রার দাবি, আন্দোলনে বসার পরে তাঁদের থানায় ডেকে বলা হয়, ‘ছেলে হয়তো পালিয়ে বিয়ে করেছে। খোঁজ পেলে জানানো হবে। মিষ্টি খাইয়ে যাবেন।’ অচেনা একটি নম্বর থেকে এক দিন তাঁদের কাছে ফোন আসে। কিন্তু অন্য প্রান্ত থেকে কারও কথা শোনা যায়নি। দেবনাথ পরিবারের সন্দেহ হয়, নিশ্চয়ই তাঁদের ছেলের ফোন। পারিবারিক এক বন্ধুর যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে শুরু হয় সেই নম্বর কোথায় ব্যবহার হচ্ছে, খোঁজ করা। সেই সূত্রেই ছেলের খোঁজ মেলে মুম্বইয়ে। সেখানে গিয়ে ছেলেকে বুঝিয়ে ২৪ অগস্ট বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসেন সুমিত্রারা।

একই অভিজ্ঞতা গিরিশ পার্কের নন্দ পরিবারেরও। হঠাৎ করে এক বন্ধুর সঙ্গে নিখোঁজ হয়ে যায় তাদের ১৬ বছরের ছেলে। শুরুতেই বাবা-মা পুলিশের দ্বারস্থ হন। অভিযোগ, এক সপ্তাহ পরেও এফআইআর দায়ের হয়নি। এমন নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজার জন্য সিআইডি-র আলাদা বিভাগ থাকলেও থানার তরফে সেখানেও কিছু জানানো হয়নি বলে অভিযোগ। শেষে ওই দুই কিশোরের খোঁজ মেলে তিন মাস পর। নিজেরাই ফোন করে তারা এক দিন জানায়, চাকরি দেওয়ার নাম করে তাদের দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কাজ তো জোটেইনি, বরং কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাদের সঙ্গের সব কিছু। অভিযোগ, এ ক্ষেত্রেও পুলিশের ভূমিকা ছিল দর্শকের মতো।

পাচার বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত একটি সংস্থার কর্মী দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘এমনটা হওয়ারই কথা নয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, নিখোঁজ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৬৩ এবং ৩৬৬এ ধারায় এফআইআর রুজু করতে বাধ্য পুলিশ। আগাম ধারণা করে এফআইআর না-করলে সেই পুলিশের বিরুদ্ধেই মামলা হতে পারে।’’ বাস্তবে তা হয় কি? ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা অন্য কথাই বলে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement