আর জু কর হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিবাদ। —ফাইল চিত্র।
কেউ লিখেছেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে ১৫০ গ্রাম বীর্য মিলেছে’। কেউ লিখেছেন, ‘তরুণী এতটাই অত্যাচারিত যে, তাঁর পেলভিক বোন আর কলার বোন ভেঙে গিয়েছে’। এ-ও লেখা হয়েছে, ‘খুন এবং ধর্ষণের সময়ে ঘটনাস্থলে থেকে আর এক মহিলাই দু’হাত চেপে ধরেছিল। অন্যরা দু’পা দু’দিকে টেনে ধরে চিরে দিয়েছে!’ এর সঙ্গে দেদার ছড়াচ্ছে নির্যাতিতার নাম, ঠিকানা ও ছবি। বাদ যায়নি মৃতদেহ উদ্ধারের সময়ের ছবিও!
আর জি করে চিকিৎসক-ছাত্রীকে খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় এমন বহু তথ্য ছড়িয়েছে সমাজমাধ্যমে। যার অধিকাংশই ভুয়ো বলে দাবি পুলিশের। ইতিমধ্যেই লালবাজার ভুয়ো তথ্য ছড়ানোর দায়ে ৭০ জনকে সমাজমাধ্যমে নোটিস পাঠিয়েছে। ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক থেকে ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, যা ছড়ানো হচ্ছে তার সব কিছু ঠিক নয়। মনোরোগ চিকিৎসকদের যদিও দাবি, ‘‘ভুয়ো তথ্যের বিস্ফোরণ ঘটেছে। ভীত সমাজকে এই ভুয়ো তথ্যের ভাণ্ডার আরও আতঙ্কিত করে তুলছে।’’
সমাজমাধ্যমে কয়েক দিন ধরে ঘুরছে তরুণীর সুরতহালের রিপোর্ট। তার পরেই ছড়ায় যে, ঘটনাস্থল থেকে ১৫০ গ্রাম বীর্য (সেমিনাল ফ্লুইড) মিলেছে। স্ত্রীরোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘এই তথ্য ভিত্তিহীন। বীর্যের ক্ষেত্রে তরলের একক মিলিলিটার ব্যবহার হওয়ার কথা, গ্রাম নয়। একটি পুরুষশরীর থেকে প্রতি বার বীর্যপাতে ১.৫-৫ মিলিলিটার বীর্য নিঃসরণ হতে পারে। অর্থাৎ ঘটনাস্থলে ১৫০ মিলিলিটার বীর্য পেতে ধর্ষকের সংখ্যা অন্তত ৩০ জন হতে হবে।’’ তাঁর দাবি, ‘‘যদি ধরি ১৫০ মিলিলিটার বীর্য মিলেছে, তা হলেও ধর্ষণের মতো ঘটনায় এর বেশির ভাগটাই হবে রক্ত। পরীক্ষাগারে পরীক্ষা ছাড়া যার ব্যাপারে কোনও কিছুই বলা যায় না।’’
সমাজমাধ্যমে আরও ছড়িয়েছে যে, নির্যাতিতার ‘পেলভিক বোন’ ও ‘কলার বোন’ ভাঙা হয়, পা মাঝখান থেকে ৯০ ডিগ্রি কোণে চিরে দেওয়া হয়। ঘটনার সময়ে তরুণীর হাত-পা অন্য কেউ চেপে ধরে ছিল। অর্থাৎ, খুনি এবং ধর্ষক একাধিক। দীর্ঘদিন ময়না তদন্তের কাজে যুক্ত, শহরের একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রাক্তন ফরেন্সিক মেডিসিনের চিকিৎসক বিশ্বজিৎ সুকুই বললেন, ‘‘সমাজমাধ্যমে অনেক কিছুই লেখা হচ্ছে। ময়না তদন্তের রিপোর্ট না দেখে কিছুই বলা সম্ভব নয়।’’
যাঁরা ময়না তদন্তের সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁরা এই নীতি মানছেন কি? ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকদের দাবি, ‘‘নিয়ম মানলে বুঝতেন, ময়না তদন্তে বাইরের ও ভিতরের আঘাত দেখার মধ্যে পার্থক্য থাকে। প্রথমে দেহের পোশাক, এর পরে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখতে হয়। সেই পর্যায়ে শরীরকে মাথা, বুক, পেট ও যৌনাঙ্গ হিসাবে ভাগ করে দেখা হয়। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওজন করে নেন অনেকে, তাতে আলাদা কোনও রোগ ছিল কিনা, বোঝা যায়। এর পরে আঘাত ধরে ধরে নম্বর দিয়ে লেখা হয়, আদালত ব্যাখ্যা চাইলে যাতে বলতে সুবিধা হয়। সেই নম্বর দেওয়াকে যদি হাড় ভাঙার নম্বর ধরা হয়, তা ভুল।’’ তাঁরা জানান, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় আত্মরক্ষায় করা আঘাত আছে কিনা, দেখতে হয়। ময়না তদন্তের চূড়ান্ত রিপোর্টের সঙ্গে পরীক্ষাগারে পাঠানো নমুনার রিপোর্ট ও পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ মিলিয়ে দেখা হয়। সেই রিপোর্ট আসার আগে কী হয়েছে, তা বলা সম্ভব নয়।
বিশ্বজিৎ আরও বলেন, ‘‘সুরতহালের রিপোর্টে মূলত শরীরের বাইরের আঘাতের কথা থাকে। ময়না তদন্তে রিপোর্টে বাইরের ও ভিতর, দু’রকম আঘাতের তথ্য মেলে।’’ ফলে সুরতহালের পরিপ্রেক্ষিতে পেলভিক বোন বা কলার বোন ভাঙা কিনা, তা বলা অসম্ভব বলে চিকিৎসকদের দাবি।
একটি বিশেষ পদবি ঘিরেও ছড়িয়েছে জল্পনা। বাস্তবে রাজ্যের মন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কিত সেই পদবি যাঁর, সেই চিকিৎসক-পড়ুয়ার বাবা এক স্কুলশিক্ষক। ছড়িয়েছে একাধিক ছবি, কল রেকর্ডিং। যা খতিয়ে দেখে পুলিশ বলছে, এর অধিকাংশই কৃত্রিম মেধার ভিত্তিতে তৈরি। মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রামের কথায়, ‘‘এই ঘটনায় যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আতঙ্কের জমি তৈরি হয়েছে, তাতেই ভুয়ো তথ্য ছড়িয়ে আতঙ্কের বীজ বপন করা হচ্ছে।’’ কে করছে? উত্তর মিলছে না। আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের দাবি, আন্দোলনকে বিপথে চালিত করতেই এমন করা হচ্ছে। মনোরোগ চিকিৎসক দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘যাঁরা ন্যায় বিচার চান তাঁরা বুঝুন, ভুয়ো তথ্য ছড়ানো হলে সে সব আন্দোলন, এমনকি তদন্তকেও বিপথে চালিত করতে পারে।’’