প্রমোদভ্রমণের ব্যবসার নামে চলতে থাকে পশু অত্যাচারের অভিযোগ উঠেএসেছে। প্রতীকী ছবি।
কোনও ঘোড়া দু’চোখেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। কোনওটির পা থেকে মাংস খুবলে বেরিয়ে এসেছে। কোনওটির পা ভাঙা। তবু সেই অবস্থাতেই উৎসাহী জনতার ভারে ন্যুব্জ গাড়ির বোঝা টেনে নিয়ে চলতে হচ্ছে! ময়দান, রেড রোড, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বর জুড়ে প্রমোদভ্রমণের জন্য ব্যবহৃত ঘোড়াগুলির এমনই অবস্থা বলে অভিযোগ। অনেকেরই দাবি, বছরভর তাদের দিকে সে ভাবে নজর দেওয়া হয় না, উল্টে শীতের সময়ে বেপরোয়া ভাব আরও বাড়ে। অভিযোগ, প্রমোদভ্রমণের ব্যবসার নামে চলতে থাকে পশু অত্যাচার।
গত বুধবার রেড রোডে ঘোড়ার গাড়িতে দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই ঘোড়াগুলি নিয়ে ফের আলোচনা শুরু হয়েছে। ওই দিন খিদিরপুর রোড-রেড রোড-ডাফরিন রোড-উট্রাম রোডের সংযোগস্থলে হঠাৎ ‘ইউ টার্ন’ করে একটি ঘোড়ার গাড়ি। তখনই পিছন থেকে আসা একটি গাড়ি সরাসরি ঘোড়ার গাড়িটির পিছনে ধাক্কা মারে। ধাক্কার অভিঘাতে রাস্তায় ছিটকে পড়েন ঘোড়ার গাড়িটিতে থাকা ভিন্ রাজ্যের একটি পরিবারের পাঁচ জন। চাকা ভেঙে ঘোড়ার গাড়িটি উল্টে যায়। ভয় পেয়ে ছিটকে বেরিয়ে যায় ঘোড়াটি। দুমড়ে যায় গাড়িটিও।
ওই ঘটনায় পুলিশ ব্যক্তিগত গাড়িটির চালককে আটক করে। কিন্তু তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘‘ব্যস্ত সময়ে যে রাস্তায় দ্রুত গতিতে গাড়ি চলে, সেখানে পুলিশ এ ভাবে ঘোড়ার গাড়ি চলতে দিচ্ছে কেন?’’ জানা যায়, ওই ঘোড়ার গাড়িটির ঘোড়াটির স্বাস্থ্য ভাল নয়। দুর্ঘটনায় তারও আঘাত লেগেছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, প্রমোদভ্রমণের নামে এ ভাবে অসুস্থ ঘোড়াদের ব্যবহার করা আর কত দিন চলবে?
বিষয়টি ইতিমধ্যেই আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। দু’টি পশুপ্রেমী সংস্থা গত বছর কলকাতা হাই কোর্টে মামলা করে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে আদালতের মনোনীত কমিটিকে পদক্ষেপ করার নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট। এর পরে চলতি বছরের অগস্টে হাই কোর্ট একটি কমিটি গঠন করে। গত ১২ সেপ্টেম্বর ময়দান এবং ওই চত্বরের ঘোড়ার মূল্যায়ন করে ওই কমিটি। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে কমিটিরই দু’ধরনের রিপোর্ট আদালতে জমা পড়েছে বলে খবর। একটিতে জানানো হয়েছে, ঘোড়াগুলির স্বাস্থ্য ভাল নয়। অন্যটিতে বলা হয়েছে, ঘোড়াগুলি ঠিকই রয়েছে। পরবর্তী শুনানির দিন এ ব্যাপারে রায় দেওয়ার কথা কোর্টের। কিন্তু মামলাকারী পশুপ্রেমী সংস্থার দাবি, মূল্যায়ন যে যথাযথ নয়, তা দু’রকম রিপোর্টেই স্পষ্ট।
একটি পশুপ্রেমী সংস্থার তরফে রাধিকা বসু বলেন, ‘‘ঘোড়াগুলির উপরে কী ধরনের অত্যাচার চালানো হয়, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ঘোড়াগুলিকে এ ভাবে ব্যবহারের বৈধতাও নেই। সবই চলছে ১৯১৯ সালের ‘ক্যালকাটা হ্যাকনি ক্যারেজ অ্যাক্ট’ অনুযায়ী, যেটি এখন অবলুপ্ত। তথ্য জানার অধিকার আইনে দরখাস্ত করে জেনেছি, হ্যাকনি ক্যারেজ আইনে সর্বশেষ ২৮টি লাইসেন্স ছিল। কিন্তু পুরনো লাইসেন্সগুলির মেয়াদ ফুরনোর পরে নতুন করে কোনও লাইসেন্স দেওয়া হয়নি।’’ রাধিকার আরও দাবি, ‘‘ওই আইন অনুযায়ী, পশুতে টানা গাড়ি পরিবহণে ব্যবহার হবে। কিন্তু ময়দান চত্বরে পরিবহণ নয়, প্রমোদভ্রমণ চলে। পুলিশের উচিত এই বিপজ্জনক সওয়ারি বন্ধ করা।’’ আর একটি পশুপ্রেমী সংস্থার এক কর্মীর দাবি, ‘‘ময়দান চত্বর সেনাবাহিনীর অধীনে। সেখানে ব্যবসায়িক কাজ চালানো কতটা ঠিক, সেটাও পুলিশের দেখা উচিত।’’
পুলিশকর্তারা জানান, বুধবারের ওই ঘটনার পরে ব্যস্ত সময়ে ময়দান চত্বরে ঘোড়ার গাড়ি চালানো বন্ধের ভাবনাচিন্তা করা হচ্ছে। কিন্তু অন্য সময়ে? ট্র্যাফিক বিভাগের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘হ্যাকনি ক্যারেজ আইন অনুযায়ী ঘোড়ার লাইসেন্স আছে কি না, খতিয়ে দেখা হবে। তা ছাড়া ব্যাপারটি বিচারাধীন। রায় যা আসবে, সেই মতো পদক্ষেপ করা হবে।’’