পুলিশের কামড় আন্দোলনকর্মীকে। ফাইল চিত্র।
গণমাধ্যম থেকে সমাজমাধ্যম, পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা কামড়ে দেওয়ার অভিযোগ ঘিরে চার দিক এখন সরগরম। তবে, কিঞ্চিত অতীতচারণ করলেই দেখা যাবে, কামড়ে দেওয়ার এই প্রবণতা আপাত ভাবে মনুষ্য আচরণসম্মত না হলেও বার বারই তা ঘটেছে। আজ যে পুলিশের বিরুদ্ধে কামড়ানোর অভিযোগ উঠেছে, অতীতে সেই পুলিশও কামড় খেয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। কী পরিস্থিতিতে, কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠলে কেউ এমন আচরণ করতে পারেন, আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে সেই বিষয়টিও।
বছরকয়েক আগের ঘটনা। নারকেলডাঙা মেন রোডে কাদাপাড়ার কাছে প্রথমে একটি পানশালায় ও পরে বাইরের রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এক তরুণী। হুমকি দিচ্ছেন, ‘‘একদম কেউ সামনে আসবে না। এলেই ঘ্যাঁক!” সেখানে তখন দাঁড়িয়ে এক অফিসার-সহ দুই পুলিশকর্মী। সকলেই ত্রস্ত। পানশালার দুই নিরাপত্তারক্ষী নিজেদের হাত চেপে ধরে কাতরাচ্ছেন। ধস্তাধস্তিতে পুলিশের জ্যাকেটের তারা লাগানো স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গিয়েছে। তরুণী বার বার তাঁর জামা টেনে বলছেন, “এই পুলিশ, এই পুলিশ, আমায় ধরবি? দেব নাকি আবার দাঁত বসিয়ে!” কথা শেষ হতে না হতেই ওই তরুণী ফের কামড়ে দিলেন পাশে দাঁড়ানো এক পুলিশকর্মীর হাতে!
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে পুলিশের এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে বহু বার। কখনও ভাড়াটে-বাড়িওয়ালার বিবাদ মেটাতে গিয়ে কামড় খেতে হয়েছে, কখনও হাসপাতালে ঢুকতে বাধা দেওয়ায় রোগীর বাড়ির লোকই দাঁত বসিয়ে দিয়েছেন কনস্টেবলের হাতে। কুখ্যাত দুষ্কৃতী হাত ছাড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়েও কামড় বসিয়েছে বহু বার।
কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে যাওয়া পুলিশই কামড়ে দিয়েছে? এমনটা মনে করতে পারছেন না প্রায় কেউই। বাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, অতীতে এক বিরোধী নেত্রী পুলিশ কামড়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ তুললেও প্রমাণ না থাকায় সেই আলোচনা বেশি দূর এগোয়নি। তাঁরা বরং বেশি আগ্রহী এই আলোচনায় যে, মানুষ কামড়ায় কেন?
মনোরোগ চিকিৎসক থেকে সমাজতত্ত্বের শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, গভীর মানসিক চাপ সামলাতে না পারাই জন্ম দেয় এমন প্রবণতার। একটি পর্যায়ের পরে এই প্রবণতার সঙ্গে ক্ষমতা যুক্ত হলে তা আরও হিংস্র রূপ নিয়ে দাঁত বসায় তাৎক্ষণিক শত্রুর শরীরে। তাঁদের দাবি, ‘‘বেশির ভাগ কামড়ই হল অবসাদ, চরম চিন্তা ও মানসিক চাপের নেতিবাচক বহিঃপ্রকাশ।’’ মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম যেমন বললেন, ‘‘আদতে এটা একটা তাৎক্ষণিক ‘অ্যাক্ট অব ভায়োলেন্স’। খুব দ্রুত কোনও পরিস্থিতি শেষ করতে চেয়েও অনেকে কামড়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করেন। চাপ সামলাতে না পেরেই অনেকে এমন কাণ্ড ঘটান।’’ মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেবের আবার দাবি, ‘‘মানুষ ছাড়া বেশির ভাগ প্রাণীরই কিন্তু বড় অস্ত্র কামড়। মানুষ এই পথে হাঁটেনি বলেই সভ্য ধরা হয়েছে। কিন্তু অসম্ভব চাপ এক সময়ে সেই সভ্যতার বেড়া ভেঙে বন্য হিংস্রতা বার করে আনে। পুলিশের কামড়ের ঘটনাতেও এমনটাই ঘটেছে।’’
মানুষের এই হিংস্রতার চিত্র ধরা পড়েছে সর্বশেষ প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’র (এনসিআরবি) রিপোর্টেও। তাতে রয়েছে, দেশে এক বছরে দু’লক্ষ ৫০ হাজার কামড়ে দেওয়ার অভিযোগ জমা পড়েছে। ৬২ শতাংশই এসেছে মহিলাদের দিক থেকে। এর মধ্যে ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহের মতো ঘটনায় কামড়ানোর হিসাব যেমন রয়েছে, তেমনই আছে সামান্য বিবাদের জেরে কামড়ানোর হিসাবও। অপরাধ বিজ্ঞানের গবেষকেরা জানাচ্ছেন, যৌন সংসর্গের সময়ে অনেকে কামড়ে দেন। সেটিকে অপরাধের মধ্যে ধরা হয় না। কিন্তু অপরাধমূলক কামড়ের ঘটনাকে পুলিশি তদন্তে আক্রমণকারী এবং আক্রান্তের দিক থেকে দু’টি পর্যায়ে ভাগ করে দেখা হয়। আক্রান্তের শরীরে যেমন কামড়ের দাগ থাকতে পারে, তেমনই দাগ থাকতে পারে আক্রমণকারীর শরীরেও। এ ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার্থে কামড়ে থাকতে পারেন আক্রান্ত। কাউকে ফাঁসানোর জন্যও কামড়কে ব্যবহার করা হতে পারে। এ জন্যই যে কোনও অপরাধমূলক কামড়ানোর ঘটনাকে ‘কমন অ্যাসল্ট’ ধরে নিয়ে ধারা যুক্ত করা হয়। কখনও কখনও এমন কামড় প্রাণঘাতী হলেও বহু ক্ষেত্রেই অভিযোগ থানা পর্যন্ত গড়ায় না।
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট অরুণিমা দত্তের মন্তব্য, ‘‘কামড়ে দেওয়াটা যে হেতু অবসাদ ও রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার বড় উদাহরণ, তাই হালকা ভাবে না নিয়ে প্রথম থেকেই গুরুত্ব দেওয়া দরকার। পুলিশও কামড়াচ্ছে মানে রাগ নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণে কি কোথাও ঘাটতি হচ্ছে বাহিনীতে?’’
পুলিশ কী ভাবছে? লালবাজারের কর্তারা কেউই এ বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি। শুধু জানানো হয়েছে, যথাযথ তদন্তের পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।