অনিয়ম: হেলমেট ছাড়াই মিলছে তেল। রাজাবাজার অঞ্চলের একটি পেট্রল পাম্পে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
দক্ষিণ কলকাতায় একটি বহুজাতিক সংস্থার পেট্রল পাম্প। সেখানে ঝুলছে ‘নো হেলমেট নো পেট্রল’-এর পোস্টার। দুরন্ত গতিতে বাইক ছুটিয়ে পাম্পে ঢুকলেন দুই যুবক। মাস্ক থাকলেও তা থুতনির কাছে নামানো। পেট্রল পাম্পের বছর চল্লিশের কর্মী ধমকের সুরে বললেন, ‘‘মাস্ক ঠিক করুন।’’ ধমক খেয়ে মাস্ক একটু মুখের উপরে তুললেন তাঁরা। তার পরে তেল ভরে বাইক চালিয়ে সেই গতিতেই বেরিয়ে গেলেন। দু’জনের কারও মাথাতেই ছিল না হেলমেট। হেলমেট না থাকলে তেল পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু পাম্পের কর্মীরা কিছুই বললেন না তাঁদের। শহরের প্রায় সর্বত্র বিভিন্ন পেট্রল পাম্পে এটাই রোজকার চিত্র। আর ভোটের মুখে সেই প্রবণতা যেন অন্য মাত্রা পেয়েছে।
তথ্য বলছে, ২০১৬ সালের ৮ জুলাই পথ নিরাপত্তা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে রাজ্য সরকার চালু করেছিল ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ কর্মসূচি। বাইক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার কমাতে বিনা হেলমেটে থাকা আরোহীদের পেট্রল পাম্প থেকে তেল দেওয়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়। প্রথম দিকে নজরদারিরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল প্রশাসনের তরফে। নিয়ম করে পুলিশকর্মীরা শহরের বিভিন্ন পাম্পে ঘুরতেন। কথা বলতেন পাম্পের কর্মীদের সঙ্গে। পেট্রল পাম্পের মালিকদের সংগঠনের সঙ্গেও কথা বলা হত পুলিশ-প্রশাসনের তরফে। শহর জুড়েই বলবৎ ছিল ‘নো হেলমেট নো পেট্রল’ বিধি। কিন্তু বর্তমানে সেই নিয়ম অধিকাংশ পাম্পেই মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ। শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ, সর্বত্রই প্রায় এক ছবি। পেট্রল পাম্পে ‘নো হেলমেট নো পেট্রল’ বোর্ড ঝুললেও কার্যক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না। রাস্তায় বিনা হেলমেটের বাইকচালকদের আটকাতে পুলিশ সক্রিয় হলেও সেই সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে না পাম্পগুলিতে নজরদারি চালানোর ক্ষেত্র। ফলে শহরের বিভিন্ন পাম্প থেকে নিয়মের তোয়াক্কা না করেই দেদার বিকোচ্ছে পেট্রল-ডিজেল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, রাজাবাজার এলাকার এক পেট্রল পাম্প কর্মী বললেন, ‘‘প্রথম দিকে বিনা হেলমেটে দেখলে তেল দিতাম না। পুলিশ-প্রশাসনের তরফেও প্রতিদিন নজরদারি চালানো হত। তবে এখন সে ভাবে নজরদারি দেখি না। এখন অবশ্য কম লোকই বিনা হেলমেটে তেল নিতে আসেন। তবে ভোট এসে যাওয়ায় বাইকচালকদের অনেকেই হাতে দলীয় পতাকা নিয়ে বিভিন্ন মিটিং-মিছিল থেকে সরাসরি পাম্পে চলে আসছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা দল বেঁধে আসেন এবং কারও মাথায় হেলমেট থাকে না। ওঁদের সঙ্গে নিয়ম দেখাতে গেলেই ঝামেলা বেধে যাবে। তাই চুপচাপ তেল দিয়ে দেওয়া হয়।’’ কিন্তু করোনাকালে নিজেদের সংক্রমিত হওয়া আটকাতেই তাঁরা বাইক আরোহীদের মাস্ক পরতে বলছেন বলে জানালেন ওই কর্মী।
বিনা হেলমেটে কসবার কাছে একটি পাম্পে তেল নিতে আসা এক যুবকের আবার যুক্তি, ‘‘আসলে কাছেই বাড়ি তো, তাই হেলমেট পরে আসিনি। এখান থেকে আমি বাড়িতেই যাব।’’
‘ওয়েস্ট বেঙ্গল পেট্রোলিয়াম ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর যুগ্ম সম্পাদক প্রসেনজিৎ সেনের দাবি, ‘‘এখন অধিকাংশ বাইকচালকই হেলমেট পরেন। রাস্তায় বেরোলে পুলিশ বিনা হেলমেটের বাইকচালকদের ক্ষেত্রে নিয়ম করেই আইনি ব্যবস্থা নেয়। ফলে বিনা হেলমেটে বাইকে চড়ার প্রবণতা কমেছে। তবে এখন ভোট এসে যাওয়ায় অনেক সময়ে দল বেঁধে দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা পাম্পে তেল ভরাতে আসেন। সে সব ক্ষেত্রে তেল না দিলে ঝামেলা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই কিছু করার থাকে না।’’
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) শুভঙ্কর সিংহ সরকার জানান, এই প্রবণতা বন্ধ করতে নিয়মিত নজরদারি চালানো হয়। পাশাপাশি বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখার আশ্বাসও দেন।