বিধি ভেঙে: উল্টোডাঙায় বর্ষবরণের জলসা। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র
ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা। সঞ্চালকের সঙ্গে মঞ্চে উঠে পড়লেন অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারাও। সমস্বরে মাইকের সামনে শুরু হল ‘গো করোনা গো’ চিৎকার। কারও মুখে মাস্ক নেই। উড়ে গিয়েছে দূরত্ব-বিধিও! দর্শকাসনে বসা অধিকাংশই মাস্ক পরেননি। মিনিট পাঁচেক সমস্বরে সেই চিৎকারের পরে ফের শুরু হল গানের আসর। চলল রাত তিনটে পর্যন্ত।
করোনা পরিস্থিতিতে জমায়েত এড়াতে জলসা নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। নির্দেশ ছিল, বর্ষশেষের রাতে যাতে এমন জলসা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে পুলিশকে। লালবাজারও জানিয়েছিল, এমন কোনও জলসার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু সেই ঘোষণা বা নির্দেশ কার্যত কথার কথা হয়েই রয়ে গেল বৃহস্পতিবার বর্ষশেষের রাতে। অভিযোগ, সব বিধি হেলায় উড়িয়ে শহরের নানা জায়গায় জলসা চলল রাতভর। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, সব দেখেও দৃশ্যত দর্শক হয়ে রইল পুলিশের টহলদার ভ্যান। মুচিবাজারের এক বাসিন্দার আবার অভিযোগ, তারস্বরে বাজতে থাকা মাইক রাত একটাতেও বন্ধ হচ্ছে না দেখে তিনি থানায় জানিয়েছিলেন। মাইক তো বন্ধ
হয়ইনি, উল্টে পাড়ার কয়েক জন যুবক তাঁর বাড়ি গিয়ে বলে এসেছে, “ঘুমোতে সমস্যা হচ্ছে মাসিমা? নতুন বছরে ঘুমোবেন। এত মাস লকডাউন ছিল, সমস্যা তো করিনি। এক দিন একটু মানিয়ে নিন।’’
আরও খবর: ২০২২-এর মার্চেই কোভিডের আগের অবস্থায় ফিরবে অর্থনীতি: নীতি আয়োগ
আরও খবর: বঙ্গ বিজেপির আড়ালের সেনাপতি শিবপ্রকাশের দায়িত্ব বাড়ল ভোটের মুখে
এলাকার বাসিন্দাদের এমনই মানিয়ে নেওয়ার ‘নির্দেশ’ দিয়ে বর্ষবরণের রাতে দেদার জলসা চলেছে যাদবপুরের পাড়ায় পাড়ায়। সেখানকার শ্রীকলোনির একটি জলসায় মাইকের বক্সের তার খুলতে গিয়েছিল পুলিশ। অভিযোগ, এলাকার এক প্রভাবশালী নেতা ফোন করে এই রাতটুকু মানিয়ে নিতে বলেছেন খোদ পুলিশকেই। যদিও পুলিশ এ ক্ষেত্রে কড়া হয়েছে। একই পরিস্থিতি টালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে। সেখানে আবার রাতের জলসায় পালিত হয়েছে এলাকার জনপ্রতিনিধির জন্মদিনও! কসবার সুইনহো লেন এবং আনন্দপুর থানার কাছে একটি পাড়ায় মাঠে আয়োজন করা হয়েছিল ‘ডিজে নাইট’। সেখানে হুল্লোড়ের পাশাপাশি রাতের পিকনিকও সেরেছেন উদ্যোক্তারা।
রাতের জলসায় দক্ষিণকে অনেকটাই টেক্কা দিয়েছে উত্তর কলকাতা। মুচিবাজার, করবাগান, রাজবল্লভপাড়া, বেলেঘাটার বিভিন্ন এলাকার পাশাপাশি বর্ষবরণের জলসা চলেছে আমহার্স্ট স্ট্রিট এবং বৌবাজারে। উল্টোডাঙা মেন রোডে তো অটো যাওয়ার লেনের পুরোটা আটকে
জলসা চলছে বড়দিন থেকে। এ দিনও সেখানে রাত তিনটে পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলেছে বলে অভিযোগ। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, শ্রীভূমি চত্বরে জলসা চলেছে পুলিশের গার্ডরেল দিয়ে ঘিরে দেওয়া জায়গাতেই।
মানিকতলা মেন রোডের একটি জলসায় আবার এক দাদার প্রকাশ্য ঘোষণা, “খারাপ বছর কাটাতে ভাল গান শোনা দরকার। তাই গানের আসর।”উত্তর কলকাতার আর এক নেতার মন্তব্য, “বহু ছেলেমেয়ে গোটা বছরটা বাড়িতে বসে। তাঁদের প্রতিভার প্রকাশ ঘটাতে এমন আয়োজন।”কলকাতা পুলিশের পঞ্চম ব্যাটালিয়নের কাছে একটি জলসার জেরে অতিষ্ঠ পুলিশ আধিকারিক বললেন, “পুলিশের লোক হয়েই জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের কথা আর কী বলব?”জলসার সঙ্গেই রাত বারোটায় ইতিউতি শব্দবাজি ফাটানোরও অভিযোগ উঠেছে। মনোহরপুকুর রোডের একটি জলসায় উদ্যোক্তারাই রাত ১২টা নাগাদ শব্দবাজি ফাটিয়েছেন বলে অভিযোগ।
আদালত এবং সরকারের নির্দেশের পরেও এমন হয় কী করে? পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা মন্তব্য করতে চাননি। তিনি শুধু জানিয়েছেন,
বিষয়টি দেখা হবে। লালবাজারের যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক আধিকারিকের দাবি, “যা হয়েছে, অন্য বারের তুলনায় অনেক কম। যেখানে যা অভিযোগ এসেছে দেখা হবে।”
কিন্তু যেখানে বাজি ফাটানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, সব রকমের জমায়েত নিয়ে সতর্ক করছেন চিকিৎসকেরা, সেখানে এমন তো হওয়ারই কথা নয়! কলকাতার পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান ফিরহাদ হাকিম বলেন, “বহু দিন ঘরবন্দি থেকে অনেকে একটু বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন। বড় কিছু ঘটেনি।”