হুল্লোড়: লেক টাউনে একদল যুবক অশালীন আচরণ করেন বলে অভিযোগ ওঠে (১), বর্ষবরণ উপলক্ষে শহর জুড়ে দেদার ফাটে বাজি (২), পার্ক স্ট্রিটে হাতাহাতি দুই তরুণীর (৩)। মঙ্গলবার রাতে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য ও সুমন বল্লভ
বছর শেষের উৎসব, না কি ‘বিশৃঙ্খলা’র প্রদর্শন? মঙ্গলবার রাতে শহরের পথঘাটের ছবি দেখার পরে কেউ এমন প্রশ্ন তুলতেই পারেন।
শুধু হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক চালানো, উন্মত্ত জনতার হুল্লোড় বা মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোই নয়, ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছোঁয়ার অনেক আগে থেকেই শব্দবাজি ফাটতে শুরু করেছিল। গভীর রাত পর্যন্ত সেই তাণ্ডব চলেছে বলে শহরবাসীর অভিযোগ। মোটরবাইক ধরতে বা ভিড় সামলাতে পুলিশি সক্রিয়তা দেখা গেলেও শব্দবাজির দাপট ঠেকাতে তারা আদৌ সক্রিয় ছিল কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। তবে লালবাজার দাবি করেছে, শহর থেকে তারা আড়াই কিলোগ্রাম বাজি বাজেয়াপ্ত করেছে।
বেপরোয়া ভাবে মোটরবাইক বা মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোর ঘটনা বর্ষশেষের রাতে নতুন কিছু নয়। কিন্তু এমন নির্বিচারে শব্দবাজি ফাটানোর ঘটনা সাম্প্রতিক কালের কোনও বর্ষশেষের রাতে দেখা গিয়েছে বলে মনে করতে পারছেন না কেউ। হরিদেবপুরের এক বাসিন্দা জানাচ্ছেন, শীতের নিশুত রাতে বাজির শব্দে কান পাতাই দায় হয়ে উঠেছিল। মধ্য কলকাতার বিভিন্ন এলাকা থেকেও শব্দবাজি ফাটানোর আওয়াজ মিলেছে। কলকাতা লাগোয়া শহরতলিতে সেই উপদ্রব ছিল আরও বেশি। পুলিশ সূত্রের খবর, শব্দবাজি ফাটানোর অভিযোগে শহরের দু’টি ক্লাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
মঙ্গলবার রাতে ঘড়ির কাঁটা দশটা পেরোতেই মানুষের ঢল নেমেছিল পার্ক স্ট্রিটের দিকে। রেস্তরাঁ, পানশালায় ভিড় তো ছিলই, সেই সঙ্গে অগুনতি মানুষকে দেখা গিয়েছে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে নিজস্বী তুলতে। পায়ে পায়ে চলতে থাকা সেই ভিড় থেকে হামেশাই উড়ে এসেছে নানা অশ্রাব্য গালিগালাজ ও কটূক্তি। পার্ক স্ট্রিট চত্বরে পুলিশি নজরদারি বেশি ছিল, তাই মোটরবাইকে সওয়ার হয়ে ‘বেপরোয়া’ মনোভাব ততটা দেখা যায়নি। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ জাদুঘরের সামনে আচমকাই ঠোকাঠুকি লাগল দু’টি স্কুটারের। দু’টিরই চালকের আসনে ছিলেন দুই তরুণী। ধাক্কা লাগার পরেই স্কুটার রাস্তায় ফেলে শুরু হল দু’জনের হাতাহাতি। আশপাশে থাকা পুলিশকর্মীরা এসে তাঁদের নিরস্ত করেন।
ভিড়ে ঠাসা পার্ক স্ট্রিটে পুলিশি কড়াকড়ি থাকলেও উত্তর বা দক্ষিণ কলকাতার তুলনামূলক ভাবে ফাঁকা এলাকায় গভীর রাত পর্যন্ত ইচ্ছেমতো বিধি ভাঙতে দেখা গিয়েছে মোটরবাইক চালকদের। রাত দেড়টা নাগাদ সুনসান বিধান সরণির উপরে দেখা গেল, কার্যত উল্কার গতিতে মোটরবাইক নিয়ে চলেছেন এক তরুণ। পিছনের আসনে বসা দুই যুবকের অবস্থা রীতিমতো বেসামাল। কারও মাথাতেই হেলমেট নেই।
এ বছর পার্ক স্ট্রিটে ভিড় সামলাতে ফুটপাত ও রাস্তায় ব্যারিকেড করে ‘একমুখী’ চলার পথ তৈরি করেছিল পুলিশ। দাঁড়িয়ে ছিলেন পুলিশকর্মীরাও। কিন্তু তাতেও পরোয়া করেননি মানুষজন। তবে যুবকদের বেচাল দেখলে ‘নরমে-গরমে’ ব্যবস্থাও নিয়েছেন পুলিশকর্মীরা। অনেকেই জানিয়েছেন, গভীর রাতে পথচলতি মহিলাদের উদ্দেশে চলন্ত গাড়ি থেকে কটূক্তির অভিযোগও আকছার মিলেছে। ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিংয়ে এমনই অসভ্যতার শিকার হওয়া এক মহিলা নিউ মার্কেট থানায় অভিযোগও দায়ের করেছেন।
অনেকেরই বক্তব্য, পার্ক স্ট্রিটে পুলিশি নিরাপত্তা ছিল। তা চোখেও পড়েছে। কিন্তু যে ভাবে শহরে বিনোদনের জায়গা বাড়ছে, তাতে বাকি এলাকাগুলিতেও কি নিরাপত্তা ও পুলিশি নজরদারি বাড়ানো উচিত নয়? লালবাজারের দাবি, শহরের যে সব জায়গায় বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয়, সেখানে যথেষ্ট পুলিশি নজরদারি ছিল। আইন ভাঙলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে বিশৃঙ্খলা যে হয়েছে, তার ইঙ্গিত রয়েছে লালবাজারের তথ্যেও। কলকাতা পুলিশ জানিয়েছে, বর্ষবরণের রাতে সারা শহরে ২৩৮৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে মত্ত অবস্থায় বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালানোর অভিযোগে ৫৩১ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, বিনা হেলমেটে মোটরবাইকে চড়ার অভিযোগে ১২৮৯ জনকে জরিমানা করা হয়েছে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ২৩৪ লিটার বেআইনি মদ ও ২১ কিলোগ্রাম গাঁজা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
অন্য দিকে, বর্ষবরণের রাতে বিশৃঙ্খলা তৈরির অভিযোগে ৭৭ জনকে গ্রেফতার করেছে বিধাননগর কমিশনারেট। পুলিশ জানিয়েছে, লেক টাউন ও শ্রীভূমির মাঝে বর্ষবরণ উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিল। পর্যাপ্ত পুলিশি নিরাপত্তাও ছিল। বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার লক্ষ্মীনারায়ণ মিনাও সেখানে ছিলেন। কিন্তু রাত ১২টার পরেই নাচগান ও বাজি পোড়ানোর নামে একদল যুবক বিশৃঙ্খলা তৈরি করেন বলে অভিযোগ। বাজি পোড়ানোর সময়ে তাঁরা অশালীন ও অভব্য আচরণ করেন বলেও অভিযোগ। এ নিয়ে অন্য একদল যুবকের সঙ্গে তাঁদের গোলমাল বেধে যায়। সেই গণ্ডগোল গড়ায় হাতাহাতিতে। তার পরে স্থানীয় লোকজনের হস্তক্ষেপে বিষয়টি মিটে যায়। পুলিশ অবশ্য ঘটনার কথা মানতে নারাজ। এ নিয়ে থানায় কোনও অভিযোগও জমা পড়েনি।
এ দিকে, ইকো পার্কের একাংশে বর্ষশেষের সন্ধ্যা থেকেই একটি অনুষ্ঠান চলছিল। সেখানে অনেকে ঢুকতে পারেননি। আবার খাবার মেলেনি বলেও অনেকে বিক্ষোভ দেখান। বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়।