নেশা-স্থান: শিয়ালদহ স্টেশন সংলগ্ন আন্ডারপাসে মোমবাতি জ্বালিয়ে (চিহ্নিত) চলছে মাদক সেবন। নিজস্ব চিত্র
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে শিয়ালদহ স্টেশন যাওয়ার ব্যস্ত আন্ডারপাসের এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে এক যুবক ও এক মহিলা। দু’জনের মাথাতেই গামছা চাপা দেওয়া। মাঝেমধ্যে মাথা তোলার চেষ্টা করছেন যুবক। পরক্ষণেই আবার নীচের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন তিনি।
পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময়ে ঝাঁঝালো গন্ধটা নাকে আসতেই থমকে দাঁড়াতে হল। দেখা গেল, গামছার আড়ালে থাকা ওই মহিলার হাতে ধরা রয়েছে একটি জ্বলন্ত মোমবাতি। তার উপরে একটি রুপোলি রঙের কাগজ ধরে তা থেকে ওঠা ধোঁয়া পাইপ দিয়ে টানছেন ওই যুবক।
‘এটা কী?’ প্রশ্নটা করতেই ঢুলুঢুলু চোখে যুবকের উত্তর, ‘‘এটা ব্রাউন সুগার, খেলেই সব টেনশন ফ্রি।’’ কোথায় পাওয়া যাবে? ‘‘এখানেই পাওয়া যাবে। টাকা দিলেই এক মিনিটের মধ্যে গিয়ে এনে দেব’’ —সটান উত্তর ওই যুবকের। ওই যুবক একা নন। সন্ধ্যার পর থেকে রাত যত বাড়ে শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরের সাবওয়ে, আন্ডারপাস, শৌচালয় জুড়ে নেশার আড্ডা ততই জমে ওঠে বলে অভিযোগ পথচারী থেকে দোকানদারদের। তাঁরাই জানাচ্ছেন, পুলিশ মাঝেমধ্যে এসে লাঠি দিয়ে মেরে তাড়িয়ে দেয় মাদকাসক্তদের। কিন্তু কিছু পরেই শিয়ালদহের আনাচ-কানাচ ফের ভরে ওঠে মাদকের ঝাঁঝালো ধোঁয়ায়।
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে শিয়ালদহ স্টেশন যাওয়ার আন্ডারপাসের নীচে প্রতিদিন বিকেল থেকে বাজার বসে। দোকানিরা জানাচ্ছেন, রাত ৮টা থেকে দোকান গোটাতে শুরু করেন তাঁরা। সেই সময়েই আন্ডারপাস কার্যত মাদকাসক্তদের দখলে চলে যায়। এই অভিযোগ যে সত্যি, তার প্রমাণ মিলল আন্ডারপাসে চক্কর কাটতেই। কোথাও নেশা করার পরে চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছেন এক যুবক। কেউ মত্ত অবস্থায় টলমল পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ আবার রুপোলি রঙের কাগজ পাকিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে ধোঁয়া টানছেন।
আন্ডারপাসের এক পাশে দুই মহিলার সঙ্গে দেখা মিলল এক যুবকেরও। গুটিসুটি মেরে তাঁরা সকলেই ব্রাউন সুগার নিচ্ছিলেন। ‘‘এগুলো খেলে কষ্ট হয় না?’’ প্রশ্নটা করতেই মলিন শাড়ি পরা মহিলা বললেন, ‘‘না খেলে তো আমরা থাকতে পারব না।’’ আর হাফ প্যান্ট, কালো গেঞ্জি পরা যুবকের জবাব, ‘‘কষ্ট হয়, কী করব? নেশা তো ছাড়তে পারব না।’’ কথার মাঝেই যুবকের দুই আঙুলের ফাঁকে ধরা পাকানো রুপোলি কাগজের মোড়কটা শেষ হল। পরক্ষণেই প্লাস্টিকের ব্যাগের ভিতর থেকে লাল, নীল, হলুদ রঙের ছোট ছোট পাঁচটা মোড়ক বার করে দিলেন পাশে বসা মহিলা। মোড়ক খুলতেই দেখা গেল, ভিতরে সাদা পাউডার জাতীয় কিছু রয়েছে। যুবক জানালেন ওই পাউডারও ব্রাউন সুগার।
একই ভাবে শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরের চত্বরে বিভিন্ন আলো-আঁধারি জায়গায় নেশা করতে দেখা গেল কয়েক জন কিশোরকে। কেউ নাকের কাছে ধরে রয়েছে রুমালের পুঁটলি, কেউ আবার প্লাস্টিকের ব্যাগের ভিতরে মুখ ঢুকিয়ে রেখেছে। প্রশ্ন করতেই জানা গেল, তারা বিশেষ এক ধরনের আঠার গন্ধ শুঁকে নেশা করে। এক কিশোরের কথায়, ‘‘সারা দিন এ দিক-ও দিক কাজ করে যা পাই, তা দিয়েই আঠা কিনি।’’ নেশার আসরের একই রকম ছবির দেখা মিলল নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পাশের হোটেলের সামনে থেকে শুরু করে শিয়ালদহ আদালতের সামনে গিয়ে ওঠা কেএমডিএ-র সাবওয়েতেও। তবে ওই সাবওয়ে রাত আটটায় বন্ধ হয়ে যায়। তাই সেখানে নেশার আসর বসে দুপুর ও বিকেলে।
মাদকাসক্তরাই জানাচ্ছেন, শিয়ালদহ স্টেশন চত্বর, বাজার এলাকাতেই বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায় ব্রাউন সুগারের মোড়ক। যা দেখতে হোমিওপ্যাথি ওষুধের মোড়কের মতো। একদম ছোট মোড়কের দাম ৫০ টাকা। আর একটু বড় হলে তার দাম ১০০ টাকা। রুপোলি রঙের কাগজের উপরে একসঙ্গে ১০-১৫টি মোড়কের ব্রাউন সুগার ঢেলে তার পরে নেশা করতে হয়। তবে যে কেউ এই মাদক কিনতে পারবেন না। যাঁরা নেশা করছেন, তাঁরাই একমাত্র গোপন ডেরা থেকে মাদক কিনে আনতে পারবেন। স্থানীয় সূত্রের খবর, শিয়ালদহ স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই এই মাদক সরবরাহের কাজ করে চলেছেন শেরু ও কাল্লু নামের দুই যুবক। তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন আরও কয়েক জন যুবক ও মহিলা।
এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ?
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান প্রবীণ ত্রিপাঠী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘গত কয়েক বছর ধরেই ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে মাদক পাচারচক্রের অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে শুধু অভিযান নয়, বিভিন্ন স্তরে সচেতনতা না বাড়ালে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।’’