সরব: সিএএ-এনআরসির বিরোধিতা করে বিক্ষোভ। মঙ্গলবার, মৌলালিতে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
চার বছর আগের কলকাতার ছবিটাই ফিরে এসেছিল কিছু ক্ষণের জন্য। ভিড়ের নিরিখে এখনই বিরাট কিছু বলার জায়গা আসেনি। কিন্তু সেই চেনা লব্জ, চেনা বিশ্বাসের স্ফুলিঙ্গই শক্ত করে মুঠো পাকাল। অনেক দিন বাদে মৌলালি থেকে পার্ক সার্কাসের পথে ফের ‘ভেদভাব’ বা বিভেদ-বিভাজনের থেকে আজ়াদির ডাক শুনল কলকাতা। দেশে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) চালু হওয়ার পরের দিনই, মঙ্গলবার বিকেলে ভগৎ সিংহ, কল্পনা দত্ত বা কাজী নজরুল ইসলামের নামে বিভাজন রোখার আওয়াজ উঠল রাজপথে।
চার বছর আগে সিএএ পাশের পরে জাতীয় পতাকা সামনে রেখে পথে নেমেছিলেন নানা সম্প্রদায়ের মেয়ে, ছাত্র, যুব, প্রবীণেরা। জনতার মুখে গান্ধী, সুভাষ, আম্বেডকরদের সঙ্গে প্রীতিলতা, ভগৎ সিংহ বা রোকেয়ার নাম। দিল্লির শাহিন বাগের মতো পার্ক সার্কাস, মেটিয়াবুরুজ, রাজাবাজারে স্থানীয় মেয়েদের নেতৃত্ব বৃহত্তর সমাজকে প্রেরণা জোগায়। ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম’ নাম দিয়ে সেই আন্দোলন ঠিক চার বছর আগে কোভিডের জন্য থমকে যেতে কেন্দ্রের শাসক পক্ষ কার্যত স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিল। এত দিন বাদে ভোটের হাওয়ায় রমজান মাস শুরুর দিনেই সেই বিতর্কিত সিএএ চালু করায় নিন্দায় মুখর ছাত্র, যুবদের একাংশ।
মৌলালির জমায়েতে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, অর্থনীতির গবেষক আরিয়ান অগ্রহরি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্রী অনুষ্ণা দাসেরা বলছিলেন, “অত্যন্ত সুকৌশলে সিএএ চালু করার সময়টা ওরা বেছে নিয়েছে। রমজান মাসে উপোসে ক্লান্ত মানুষকে প্রতিবাদে ঠেলে দেওয়াটা চরম নিষ্ঠুরতা।”
চার বছর আগে পার্ক সার্কাসের মাঠে দৃপ্ত স্বরে ‘তোমার বুকে নাথুরাম, আমার বুকে ক্ষুদিরাম’ বলে স্লোগান দিতেন আইনের ছাত্রী শাফকাত রহিম। যাদবপুরের প্রাক্তনী, স্বাধীন সংবাদকর্মী বন্ধু নবমিতা চন্দের ফোন পেয়ে তিনি উপোস রেখেই এ দিন বিকেলের মিছিলে হাজির। হেসে বলছিলেন, “গাজ়ায় রোজাক্লিষ্ট লোকের উপরে হামলার নজির আছে। এটাও খানিক তেমনই হল।” আরও অনেকের মতো শাফকাতও মনে করেন, সিএএ-র পরের ধাপ এনআরসি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জি)-র ফাঁদে শুধু গরিব মুসলিম নন, ভিন্ রাজ্যে কর্মরত যে কোনও বাঙালি শ্রমিক বা সুবিধা বঞ্চিত শ্রেণির অনেকে নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে বিপদে পড়বেন।
একই সুর শোনা গেল ‘নো এনআরসি মুভমেন্ট’-এর কমল শূর, ফরিদুল ইসলাম, শর্মিষ্ঠা রায়দের মুখে। চার বছর আগে পার্ক সার্কাসের মেয়েদের প্রতিবাদী অবস্থানের মুখ আসমাত জামিল এখন প্রয়াত। সেই আন্দোলনের অন্য সংগঠকেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। ব্রাইট স্ট্রিটের এক চিকিৎসকের স্ত্রী তবাসুম সিদ্দিকী ছিলেন পার্ক সার্কাসের নিয়মিত মুখ। তিনি বলছিলেন, “রোজার মাসে কষ্ট হলেও আমরা লড়ব। দ্রুত অনেকে আলোচনায় বসছি।”
পার্ক সার্কাসের আর এক মুখ, ইতিহাসের গবেষক নওশিন বাবা খান এখন আধারের তথ্য লোপাট নিয়ে আন্দোলনে তিস্তা শেতলবাদের ‘সিটিজেন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস’-এর সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁদের সহযোগী মেটিয়াবুরুজের জিতেন্দ্রনাথ নন্দী বলছিলেন, “সীমান্ত এলাকায় দেখেছি, ১৫-২০ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষজনকে ভয় দেখিয়ে আধার নিষ্ক্রিয় করে বিপদে ফেলা হচ্ছিল। এ বার সিএএ চালু করে তাঁদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। আমরা অনেককেই বোঝাচ্ছি, সিএএ-র ফাঁদে পা দিলে নিজের নাগরিকত্ব নিয়ে সঙ্কটই তৈরি হবে।” তিস্তা বলছিলেন, “সিএএ-র মধ্যে বৈষম্যের কথা বলে বেশ কিছু মামলা সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে। এই আইন গরিব-বিরোধী, সেটা বোঝানো দরকার।”
আজ, বুধবার ‘ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা’ বলে একটি নাগরিক মঞ্চ মৌলালি যুব কেন্দ্রে সিএএ-র বিপদ নিয়ে কথা বলবে। ‘জয়েন্ট ফোরাম এগেনস্ট এনআরসি’ মঞ্চের প্রসেনজিৎ বসু, মনজর জামিলেরা ইতিমধ্যেই নানা শ্রেণির মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছেন। প্রসেনজিৎ বলছিলেন, “মতুয়া, দলিত, মুসলিম থেকে শুরু করে শহরের নামী সংস্কৃতি কর্মী, শিল্পীদের সাড়া পাচ্ছি। নাগরিকত্ব দেওয়ার নামে সিএএ আসলে ভাঁওতা বলে অনেকেই বোঝেন।” মনজর বলেন, “শনিবার একটা সভায় সবাই মিলে কর্মসূচি ঠিক করব। শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের শক্তি ফের শাসককে বোঝানোই লক্ষ্য।”