—প্রতীকী চিত্র।
সরাসরি ট্রামলাইনের উপরেই পর পর দাঁড়িয়ে অটো। সেটাই নাকি অটোস্ট্যান্ড! কিন্তু অটোগুলির কোনওটি সল্টলেক রুটের, কোনওটি ভিআইপি রোডের, কোনওটি আবার উল্টোডাঙা থেকে শোভাবাজার রুটের। আলাদা আলাদা রুটের গাড়ি নিয়ে একটা অটোস্ট্যান্ড হয় কী করে? প্রশ্ন করতেই উল্টোডাঙার একটি ওষুধের দোকানের মালিক বললেন, ‘‘শুধু বেআইনি স্ট্যান্ডটাই দেখলেন? ওখানে তো কোনও অটো রুটই নেই। অথচ দিনের পর দিন উল্টোডাঙা থেকে ফুলবাগান পর্যন্ত লোক তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে!’’
উল্টোডাঙায় একটি আবাসনে অটো এবং বাইকবাহিনী ঢুকে ডিজে বাজিয়ে বিজয় মিছিল করার পরিপ্রেক্ষিতে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেওয়ার পরে খোঁজখবর করতে গিয়ে ওই চত্বরের অটো-দৌরাত্ম্যের এমনই চিত্র সামনে এল। অভিযোগ, ওই এলাকার ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের পুরপ্রতিনিধি শান্তিরঞ্জন কুণ্ডুর নেতৃত্বে ওই বাইক ও অটো বাহিনী আবাসনে ঢুকে বিজয়োৎসবের নামে হুল্লোড় করে। সূত্রের খবর, যা কানে যেতে মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেন, ‘‘কে শান্তি? এত সাহস হয় কী করে?’’ এর পরে এ নিয়ে তিনি ক্ষমা চাওয়ারও নির্দেশও দেন। যদিও জানা গেল, শুধু পুরপ্রতিনিধি নন, ছোট-বড়-মাঝারি নানা স্তরের নেতা-দাদাদের হাত মাথায় থাকায় সারা বছরই সেখানে চলতে থাকে ‘অটো-রাজ’। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিবাদ করেও লাভ হয় না। পুলিশে অভিযোগ করলে সমাধানের পরিবর্তে বাড়ি এসে অটো ইউনিয়নের লোকজন শাসিয়ে যায়।
যে রুট নিয়ে ওই এলাকায় মূল অভিযোগ, সেটি উল্টোডাঙা ট্রাম ডিপোর কাছে তৈরি হয়েছে কয়েক বছর আগে। উল্টোডাঙা রেলস্টেশনের পাশ থেকে ওই রুটে ফুলবাগান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয় যাত্রীদের। ভাড়া কমবেশি ১৫ টাকা। রেললাইনের পাশের সিআইটি রোড ধরে মানিকতলা মেন রোড পর্যন্ত পৌঁছে কখনও গলিপথে ফুলবাগান পর্যন্ত, আবার কখনও মূল রাস্তা ধরেই কাঁকুড়গাছি মোড় থেকে ফুলবাগানের দিকে যায় অটোগুলি। যদিও পরিবহণ দফতরের কর্তাদের দাবি, খাতায়কলমে ওই চত্বরে এমন কোনও অটো রুটের অস্তিত্ব নেই।
তা হলে চলে কী করে? পাশের একটি অটো রুটের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাহেব দাস ওরফে সুমন বললেন, ‘‘আমরা সব ট্যাক্স দিয়ে চালাচ্ছি। আর ওই রুট কী ভাবে চলছে, আমরা ভেবেই অবাক।’’ যদিও উল্টোডাঙা থেকে ফুলবাগান রুটের এক অটোচালকের মন্তব্য, ‘‘আমাদের যা কিছু সমস্যা, দাদা বুঝে নেন। দাদা একটা ফোন করে দিলেই সব ঝামেলা মিটে যায়।’’
জানা গেল, শুধু রুট চালানোই নয়। ওই রুটে কোন অটো চলবে আর কোনটা চলবে না, সবই ঠিক করেন ওই চত্বরের এক নেতা-দাদা। রুটের অটো কারা চালাবেন, সেটাও ঠিক হয় ওই দাদার প্রতি সংশ্লিষ্ট অটোচালকের আনুগত্য আছে কি না, তার উপরে। দাদার নির্দেশেই দিনভর আসল রুটে অটো চালিয়ে বাড়তি আয়ের জন্য কাটা রুটের কাজে আসেন অনেকে। অভিযোগ, ভাড়াও ঠিক হয় দাদার মর্জিমতো। দাদার সঙ্গে ‘সেটিং’-এর জোরেই গলিপথ ছেড়ে মূল সড়ক ধরেই ছুটে চলে অস্তিত্বহীন রুটের অটোগুলি। অভিযোগ, পুলিশ দেখেও কিছু বলে না। বেশি ধরপাকড় করলে সংশ্লিষ্ট পুলিশকর্মীরই দ্রুত বদলি হয়ে যায়।
উল্টোডাঙা থেকে শোভাবাজার মোড় রুটের এক অটোচালক বললেন, ‘‘প্রতিদিনের ২০ টাকা হিসাবের খাতা চলে। দাদার ছেলেদের এই টাকা না দিলে উল্টোডাঙায় অটো দাঁড় করাতেই দেওয়া হয় না। নতুন অটো নামাতে গেলেও আগে এই দাদাকে কত দিতে হবে, সেই হিসাব করতে হয়।’’ উল্টোডাঙা থেকে আহিরীটোলা রুটের এক অটোমালিকের আবার অভিযোগ, ‘‘নিজের গাড়ি নিজে চালাই। কিন্তু কখনও অসুস্থতার কারণে অন্য কেউ গাড়ি চালালে আলাদা লোক রাখার জন্য প্রতিদিন ২০ টাকা করে বেশি দিতে হয়!’’ ওই নেতা-দাদার প্রভাব এমন যে, রাতারাতি আইনজীবী পুরপ্রতিনিধিকে সরিয়ে তাঁকেই উত্তর কলকাতার যুবর দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়। তিনি চাইলে ঘুরপথে সল্টলেকে অটো নিয়ে ঢোকার ব্যবস্থাও হয়ে যায়। ফি বছর রাস্তা আটকে গণেশপুজো থেকে বর্ষবরণের জলসাও চলে।
মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্রে আসন্ন উপনির্বাচনের আগে তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ এ নিয়ে বললেন, ‘‘দলনেত্রী যথাযথ নির্দেশ দিয়েছেন। সমস্যার জায়গাগুলি সব দ্রুত দেখে নেওয়া হচ্ছে।’’