ফাইল চিত্র
কারও মনে চেপে বসেছে করোনার তৃতীয় ঢেউ এসে পড়ার ভয়। কারও আবার পিছু ছাড়ছে না কর্মহীন হয়ে পড়ার আতঙ্ক। কেউ ভাবছেন, প্রতিষেধক নেওয়া থাকলেও কাজ হবে তো? কেউ আবার সর্বক্ষণ ডুবে থাকছেন করোনায় সঙ্গী বা কোনও নিকটাত্মীয়কে হারানোর অবসাদে। অনেকের ক্ষেত্রেই ফিরে ফিরে আসছে পুরনো কোনও দুর্ঘটনা, শারীরিক বা মানসিক আঘাতের ভয়াবহ স্মৃতি। রোগ যে সেরে উঠছে, তা বিশ্বাস করতে না-পারার সমস্যা তৈরি হচ্ছে বহু ক্ষেত্রেই।
করোনার জেরে বিপর্যস্ত মানসিক স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধারেই এ বার বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। প্রথম দফায় সেখান থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা ৫০০ জনকে নিয়ে ‘মনের ক্লাস’ শুরু করেছে তারা। যা চলবে বেশ কয়েক দফা। সম্প্রতি শুরু হওয়া সেই ক্লাসে করোনাজয়ীদের ধরে ধরে নানা প্রশ্ন করার পাশাপাশি মনের তল পেতে যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ এবং সংখ্যা নিয়ে খেলাও করানো হয়েছে। ভিডিয়ো কলে আঁকানো হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ছবিও। ওই হাসপাতালের মেডিসিনের চিকিৎসক তথা এই ক্লাসের অন্যতম উদ্যোক্তা অরুণাংশু তালুকদার বললেন, “শারীরিক স্বাস্থ্য অনেকটাই নির্ভর করে মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে। করোনা শুধু শারীরিক ভাবে নয়, মানসিক ভাবেও চরম বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। এই সময়ে রোগীকে মানসিক চিকিৎসার পরিষেবা দেওয়া একটা বড় ব্যাপার তো বটেই, সেই সঙ্গে কোন কোন ধরনের সমস্যা উঠে আসছে, সেই সংক্রান্ত স্পষ্ট ধারণা পেতেও অত্যন্ত কার্যকর হচ্ছে এই উদ্যোগ। যা প্রতি মাসে রিপোর্ট আকারে পাঠানো হচ্ছে স্বাস্থ্য ভবনে।”
এই উদ্যোগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সাইকায়াট্রি বিভাগের ক্লিনিক্ল্যাল সাইকোলজিস্ট গার্গী দাশগুপ্ত জানালেন, ১৮-৩০, ৩০-৪৫, ৪৫-৬০ এবং ৬০-এর বেশি বয়সি লোকেদের মোট চারটি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। প্রশাসনিক কড়াকড়ির জন্য হাসপাতালে ডেকে আনা যে হেতু সমস্যার, সেই কারণে অনলাইনেই শুরু হয়েছে ক্লাস। সেখানে ডিএএসএস-২১ (ডিপ্রেশন অ্যাংজ়াইটি অ্যান্ড স্ট্রেস স্কেল) পদ্ধতিতে করোনা থেকে সেরে ওঠা রোগীর কাছে মোট ২১টি প্রশ্ন রাখা হয়। যে প্রশ্নগুলির উত্তর আদতে জানান দেয়, রোগী মানসিক ভাবে কতটা বিপর্যস্ত এবং জীবন নিয়ে তাঁর মধ্যে কী ধরনের ভয় বা অনীহা রয়েছে। একই ভাবে রোগীর কোন ধরনের ট্রমা রয়েছে, তা মাপা হচ্ছে পিটিএসডি বা ‘পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিজ়অর্ডার’ স্কেলে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, কোনও রোগী অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেন ভুলতে পারছেন না। কেউ আবার প্রায় প্রতি রাতে করোনার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনও না কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছেন। সব শেষে থাকছে ‘মনট্রিয়াল কগনিটিভ অ্যাসেসমেন্ট স্কেল’। যা আদতে পেপার, পেনসিল টেস্ট। এ ক্ষেত্রে মাথাকে নানা ভাবে চালনা করে দেখা হচ্ছে, সে কতটা সক্রিয়। থাকছে ছবি আঁকানোর মতো ব্যাপারও।
গার্গীদেবী বলেন, “এই কাজগুলো করাতে গিয়েই দেখছি, এক-এক জন রোগী মানসিক ভাবে কতটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বহু ক্ষেত্রেই জীবনের মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। কারও স্মৃতিশক্তিজনিত সমস্যা হচ্ছে, কেউ সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যায় পড়ছেন। কারও আবার জীবনের পুরনো ট্রমা ফিরে আসছে। করোনা থেকে সেরে ওঠা এক রোগী যেমন কিছুতেই সুস্থ হতে পারছিলেন না তাঁর পুরনো একটি গাড়ি দুর্ঘটনার স্মৃতি জীবন্ত হয়ে ওঠায়। দিন কয়েকের চিকিৎসার পরে তিনি এখন অনেকটাই সুস্থ।” তাঁর পরামর্শ, “কারও কারও ক্ষেত্রে চার-পাঁচ মাস পরেও এই ধরনের সমস্যাগুলো সামনে আসছে। আমাদের মতো দেশে, যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সে ভাবে কোনও সচেতনতাই নেই, সেখানে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এই উদ্যোগ করোনাকে হারাতে আমাদের আরও এক ধাপ এগিয়ে রাখবে। রোগীকেও মনের সমস্যা খুলে বলতে হবে।”