জল-যন্ত্রণা: জল জমার জেরে শনিবারও চলল মানুষের ভোগান্তি। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে। ছবি: সুমন বল্লভ
শহরের জলমগ্ন জায়গা ধরে ধরে নদীর নাম অমুক, নদীর নাম তমুক বলে ডাকা কেন! শুক্রবার রাতভর এবং শনিবার বিকেল পর্যন্ত হওয়া একটানা বৃষ্টিতে গোটা কলকাতাকেই কার্যত নদী বলে ডাকার পক্ষপাতী অনেকে! বিকেলের দিকে কিছু কিছু জায়গায় জল নামলেও সকাল থেকে শহরের সেই ‘নদীপথে’ ঘুরে দেখা গেল ভোগান্তির চরম চিত্র।
রাস্তা বন্ধ: বাংলাদেশ সংলগ্ন গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে বিস্তৃত ঘূর্ণাবর্তের জেরে বৃষ্টি শুক্রবার এমন আকার নেয় যে, উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার প্রায় সমস্ত বড় রাস্তাতেই জল দাঁড়িয়ে যায়। এমনটাই জানিয়েছে লালবাজার। এ দিন সকালেও বৃষ্টি না থামায় কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে পার্ক স্ট্রিট, এ জে সি বসু রোড, শরৎ বসু রোড, আলিপুর রোড এবং বালিগঞ্জের বিভিন্ন রাস্তা। অন্য পথে গিয়ে অনেককে আবার ব্যাপক গাড়ির জটে আটকে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আলিপুর রোডে দুর্ঘটনায় পড়া এক ব্যক্তি বলেন, ‘‘রাস্তার কোথায় কোথায় গর্ত রয়েছে, বোঝাই যাচ্ছে না। পড়ে গিয়ে হাত-পা কেটে গিয়েছে।’’
উত্তরের কলেজ স্ট্রিট, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, মুক্তারামবাবু স্ট্রিট, সুকিয়া স্ট্রিট, মানিকতলা মেন রোড এবং ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি সংলগ্ন এলাকারও একই অবস্থা। গাড়ির লম্বা লাইন দেখা যায় জলমগ্ন চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়েও। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে আসা, নাকে নল গোঁজা এক বৃদ্ধ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুরো ভিজে যান গাড়ির চাকার জলের ঝাপটায়। ফের তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। এন্টালি, সার্কুলার গার্ডেনরিচ রোড, হাইড রোড ও স্ট্র্যান্ড রোডের অবস্থা এমন হয় যে, এক দিক বন্ধ করে গাড়ি চলাচল করাতে হয় পুলিশকে। কৈখালির কাছে সম্পূর্ণ জলমগ্ন ছিল ভিআইপি রোড। সেখানে রাস্তায় সাঁতার কাটতে দেখা যায় খুদেদের। জল জমে এ দিন হাওড়া কারশেডের পাঁচটি লাইন ডুবে যায়। বেশ কয়েকটি ট্রেন বাতিল হয়। এক সময়ে প্রিন্সেপ ঘাট থেকে বাগবাজার পর্যন্ত চক্ররেল পরিষেবাও বন্ধ হয়ে যায়।
জলমগ্ন বালিগঞ্জে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
যেখানে জল থাকার কথা নয়, সেখানেও: ট্যাংরায় প্রয়োজনীয় সামগ্রী বুকে জড়িয়ে এ দিন দুপুরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েক জন। পাশেই পুরনো বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়েছে। সেই ভয়ে? এক জন বললেন, ‘‘ঘরে জল ঢুকেছে। রাস্তাই ভরসা।’’ একই অবস্থা বেহালার বিভিন্ন এলাকাতেও। বাদ যায়নি সেখানকার স্কুল-কলেজ, আদালত, থানা, এমনকি
হাসপাতালও। এ দিনও জলমগ্ন ছিল এসএসকেএম এবং ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কিছু জায়গা। একবালপুর থানার জল নামাতে হিমশিম খেতে হয় পুলিশকে। আলিপুর আদালতে আবার আইন-চর্চা চলেছে গোড়ালি ডোবা জলে দাঁড়িয়েই!
দুর্ঘটনামালা: প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই শহরে চারটি পথ দুর্ঘটনার পাশাপাশি ট্যাংরায় একটি পরিত্যক্ত গুদামের ছাদ ভেঙে পড়ে এ দিন সকালে। ভিতরে চাপা পড়েন শেরু সিংহ নামে সেখানকারই এক নিরাপত্তাকর্মী। পুলিশ গিয়ে কোনও মতে তাঁকে উদ্ধার করে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন।
পড়ল গাছ, উপড়োল বাতিস্তম্ভ: দক্ষিণ কলকাতার সর্দার শঙ্কর রোডে গাড়ির উপরে ভেঙে পড়ে একটি গাছ। যার জেরে ওই এলাকায় প্রবল যানজট হয়। তবে এই ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে আবার একটি গাছ এমন ভাবে ভেঙে পড়ে যে, পাশের বাতিস্তম্ভও উপড়ে যায়। বিপজ্জনক ভাবে রাস্তায় ঝুলতে থাকে বিদ্যুতের তার। পুলিশ ও বিদ্যুৎ দফতরের কর্মীরা এসে বাতিস্তম্ভ মেরামত করেন।
ইচ্ছে-ভাড়া: ঝোপ বুঝে কোপ মারার পুরনো রেকর্ড বজায় রাখল শহরের হলুদ ট্যাক্সি ও অটো। সঙ্গে চলল দাপটে যাত্রী-প্রত্যাখ্যানও। বৃষ্টির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চড়া ভাড়া হাঁকল অ্যাপ-ক্যাবগুলিও। শোভাবাজার থেকে উল্টোডাঙা পর্যন্ত ১২ টাকা ভাড়া এক সময়ে বেড়ে দাঁড়াল ৩০ টাকায়। একই অবস্থা মানিকতলা মেন রোড, বেলেঘাটা, শিয়ালদহ, টালিগঞ্জ, রাসবিহারী ও গড়িয়াহাট রুটেও। এক যাত্রী বলেন, ‘‘ভাগ্যিস অনেক অফিসে আজ অর্ধদিবস ছুটি ছিল!’’
মেয়র-উবাচ: শহরের জলমগ্ন জায়গাগুলি দিনভর ঘুরে দেখে ফিরহাদ হাকিম বললেন, ‘‘অন্তত চার-পাঁচ ঘণ্টা টানা শুকনো পেলেই সব মিটে যাবে! জল নেমে যাবে।’’