অসহায়: এসএসকেএম থেকে ‘রেফার’ হয়ে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে এসেও ভর্তি হতে পারেননি নিমাই দাস। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
এসএসকেএম হাসপাতালের এক ভবন থেকে আর এক ভবনে অন্তত পাঁচটি ওয়ার্ডে ঘোরানোর পরে রোগীর পরিবারকে শয্যা নেই বলে জানানো হয়। অভিযোগ এমনই। পরিবারের লোকজনের দাবি, সেখান থেকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ‘রেফার’ করার পরেও ভোগান্তি কমেনি! অভিযোগ, কয়েকটি ভবন ঘোরার পরে ন্যাশনালের মেডিসিন বিভাগ থেকে বলা হয়, ‘‘চাইলে ভর্তি করাতেই পারেন। কিন্তু রোগীর যা চিকিৎসা দরকার, তা এখানে হয় না। ক’দিন পরে দেখবেন, করোনায় মৃতদের নামের সঙ্গে এই রোগীর নামও প্রকাশ করা হবে!’’
নিমাই দাস নামে গড়িয়ার বাসিন্দা বছর পঞ্চান্নর ওই রোগীকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়ে ছেলে পলাশ বললেন, ‘‘চিকিৎসকেরা বলছেন, বাবার পেটের টিউমার ক্যানসারের দিকে যাচ্ছে। এখানে যদি এই রোগের চিকিৎসা না-ই হয়, তা হলে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা রোগীকে দেখেও কেন তাঁকে এখানে পাঠাল এসএসকেএম?’’ হতাশ গলায় তাঁর মন্তব্য, ‘‘চিকিৎসা না হলে এখানে ফেলে রেখে লাভ কী? তার থেকে শেষের ক’টা দিন বাড়িতেই থাকুক। অন্তত করোনা তো হবে না!’’
করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি হাসপাতালে অন্য রোগে আক্রান্তেরা পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে প্রতিদিনই অভিযোগ উঠছে। সম্প্রতি ন্যাশনাল মেডিক্যালে গিয়েও দেখা গেল রোগী হয়রানির নানা চিত্র। জরুরি অস্ত্রোপচারের জন্য সেখানে আসা একাধিক রোগীর পরিবারের দাবি, গত দু’মাসে প্রতি সপ্তাহে সেখানে গেলেও প্রতিবারই ফিরে যেতে হয়েছে স্রেফ কয়েকটি শারীরিক পরীক্ষা করিয়েই। ‘রেফার’ হয়ে আসা রোগীদের পরিবারের আবার অভিযোগ, দিনভর এক ভবন থেকে অন্য ভবনে ঘোরানোর পরেও নতুন তারিখ লিখে দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘‘ওই দিন আসুন। এখন হাসপাতালে পড়ে থেকে লাভ নেই। করোনা থেকে বাঁচতে হলে বাড়ি যান।’’
নিমাই দাসের পরিজনেরা জানালেন, মাস ছয়েক ধরেই তিনি পেটের সমস্যায় ভুগছেন। সোনারপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে গেলে জানানো হয়, তাঁর পেটে টিউমার রয়েছে এবং তা ক্যানসারের দিকে যাচ্ছে। এমনটাই দাবি নিমাইবাবুর পুত্রবধূ ঋতু দাসের। তিনি বলেন, ‘‘আমার স্বামী পেশায় কলমিস্ত্রি। বেসরকারি জায়গায় দেখানোর টাকা নেই। গত সোমবার তাই শ্বশুরমশাইকে নিয়ে চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে যাই। সেখান থেকে এসএসকেএমে রেফার করে দেওয়া হয়।’’ এর পরে তাঁর দাবি, ‘‘এসএসকেএমে একটি থেকে আর একটি ভবনে ঘোরানোর পরে বলা হয়, শয্যা নেই। ন্যাশনাল মেডিক্যালে যান। ন্যাশনাল তো কার্যত করোনার ভয় দেখাল!’’
একই রকম অভিযোগ করলেন যাদবপুরের বাসিন্দা, বছর আটাত্তরের তিনুরঞ্জন সরকারের পুত্রবধূ কৃষ্ণা সরকার। তাঁর কথায়, ‘‘শ্বশুরমশাই অনেক দিন ধরে ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছেন। সে দিন সন্ধ্যায় হঠাৎ প্রবল বমি আর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। যাদবপুরেরই একটি ছোট বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা ওঁর অবস্থা দেখে ভর্তি নিতে চায়নি। সেখান থেকে এম আর বাঙুর হাসপাতালে যাই। সেখানে আমাদের দেখেই বলা হয়, রোগীর তো বটেই, এখানে দাঁড়ালে আপনাদেরও করোনা হবে! এখানে করোনা ছাড়া অন্য চিকিৎসা হয় না।’’
ওটা যে করোনা হাসপাতাল, জানতেন না? কৃষ্ণাদেবীর দাবি, ‘‘আমরা জানতাম না। এসএসকেএম হাসপাতালও কি জানত না? সেখান থেকেই তো এম আর বাঙুরে যেতে বলা হল!’’ মহিলা বলেন, ‘‘এম আর বাঙুর ফিরিয়ে দিতে এসএসকেএমে যাই। সেখানে একাধিক ভবনে ঘোরানোর পরে জানানো হয়, শয্যা নেই। এম আর বাঙুরেই যান। আমরা বলি, ওটা তো করোনা হাসপাতাল? এসএসকেএমের এক চিকিৎসক বললেন, কে বলেছে? সব চিকিৎসাই হচ্ছে!’’ মহিলা জানান, ফের তাঁদের দেখে এম আর বাঙুর ন্যাশনাল মেডিক্যালে পাঠিয়ে দেয়। তাঁর কথায়, ‘‘রাত আড়াইটে নাগাদ এখানে শ্বশুরমশাইকে ভর্তি করাতে পারলেও এখনও পর্যন্ত তাঁর খোঁজ পাইনি।’’
কৃষ্ণাদেবীদের অভিযোগ, ভর্তি নেওয়ার পরে ফুসফুসের চিকিৎসার বদলে রোগীকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। সেখানে রোগী কেমন আছেন, সে দিন রাত পর্যন্তও সেই খবর পাননি তাঁরা।
রোগী-হয়রানির এই চিত্র কেন? ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ অজয় রায় সবটা শুনে কথা বলতে না চেয়ে ফোন কেটে দেন। সুপার সন্দীপ ঘোষ বলেন, ‘‘কোনও রোগীর পরিবারের সঙ্গে এমন ব্যবহার অনভিপ্রেত। পরিবার লিখিত অভিযোগ করলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেব!’’
হয়রানির শিকার হওয়া রোগীর আত্মীয়দের প্রশ্ন, ‘‘এই মুহূর্তে রোগীকে বাঁচাব, না লিখিত অভিযোগ করব? এত ঘটনার পরেও হাসপাতাল কেন মানবিক হবে না!’’