যখের ধনের মতো করে তিনি কোটি কোটি সরকারি টাকা আগলে বসে রয়েছেন। অথচ, টাকা না-পেয়ে কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় অন্তত সাতটি ইএসআই হাসপাতালে ওষুধ সংস্থাগুলি প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে দিচ্ছে। ধুঁকতে থাকা গরিব রোগী জীবনদায়ী অ্যান্টিবায়োটিক, ইঞ্জেকশন পাচ্ছেন না, ক্যানসার-আক্রান্তের কেমোথেরাপি হচ্ছে না, হিমোফিলিয়ার রোগী রক্তের অতি জরুরি ফ্যাক্টর না পেয়ে ক্রমশ নির্জীব হয়ে পড়ছেন। রক্তের জটিল রোগে আক্রান্ত প্রাণদায়ী ইঞ্জেকশন পাচ্ছেন না।
হাসপাতালের সুপারেরা এমনকী খোদ দফতরের মন্ত্রীর অফিস থেকেও তাঁকে বিপুল পরিমাণ টাকা আটকে রাখার কারণে উপরোধ-অনুরোধ থেকে শুরু করে সরাসরি ভর্ৎসনা পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু তিনি তার পরেও নির্বিকার!
এই ‘তিনি’ হলেন রাজ্যের ইএসআই মেডিক্যাল বেনিফিট স্কিমের অধিকর্তা মৃগাঙ্কশেখর কর। তাঁর হেফাজতে এখন ৪৭ কোটি টাকা রয়েছে। কিন্তু তিনি ওষুধের বিল মেটানোর জন্য হাসপাতালগুলিকে টাকা ছাড়ছেন না বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অধিকর্তা অবশ্য নির্লিপ্ত গলায় যুক্তি দিয়েছেন, হঠাৎ করে বেশি টাকা ভাঁড়ারে এসে গিয়েছে, তাঁর হাতে লোক কম, একটু দেখেশুনে টাকা ছাড়তে হয়, তাই দেরি হবেই!
ইএসআই হাসপাতালগুলির উপর চিকিৎসার জন্য নির্ভরশীল প্রায় ১২ লক্ষ মানুষ, এঁরা সকলেই মূলত দরিদ্র শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষ। অভিযোগ, কোটি কোটি টাকা বকেয়া হওয়ার জেরে ওষুধ বাড়ন্ত হওয়ায় সবচেয়ে বেশি হেনস্থা হতে হচ্ছে এই মানুষগুলিকে। গত সপ্তাহে শিয়ালদহ ইএসআই হাসপাতাল থেকে কেমোথেরাপি নেন এমন অন্তত জনা পনেরো ক্যানসার রোগী তাঁর অফিসে গিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়ে এসেছেন। তাঁরা গত প্রায় দেড় মাস কেমোর অত্যন্ত দামি ওষুধ হাসপাতাল থেকে নিখরচায় পাচ্ছেন না। টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। অধিকাংশের পক্ষেই সেটা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কেমোও বন্ধ।
শ্রম দফতর সূত্রের খবর, গত ১৬ জুন এ ব্যাপারে শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক ডাকেন। সেখানে সকলের সামনেই টাকা আটকে রাখার জন্য অধিকর্তাকে ভর্ৎসনা করেন এবং সাত দিনের মধ্যে বকেয়া মিটিয়ে দিতে বলেন। সেই সাত দিনও পার হয়ে গিয়েছে, অবস্থা বদলায়নি।
মলয়বাবু অবশ্য মুখে ভর্ৎসনার কথা স্বীকার করেননি। বিষয়টি এড়ানোর চেষ্টা করে বলেছেন, ‘‘আমি কাকে কী বলেছি সেটা আপনাদের জানাব না। তবে টাকা তো দুমদাম করে দেওয়া যায় না। তাতে গোলমাল হতে পারে।’’ তা হলে কি মন্ত্রী টাকা ছাড়তে এই বাড়াবাড়ি রকম দেরিকে সমর্থন করছেন? এর জন্য মাসের পর মাস কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় ইএসআই হাসপাতালগুলিতে ওষুধের যে ব্যাপক আকাল চলছে এবং রোগীদের যে ভাবে হেনস্থা হতে হচ্ছে তাকেও অন্যায় মনে করেন না? এ বার মন্ত্রীর ইতস্তত জবাব, ‘‘আমি কখনই দেরিতে টাকা ছাড়া সমর্থন করি না। সেটা বরদাস্ত করা হবেও না।’’
দেরিতে টাকা ছাড়ার নমুনাটা ঠিক কী রকম? গত বছর অগস্ট থেকে চলতি বছর মার্চ পর্যম্ত গত ২০১৫-১৬ আর্থিক বর্ষেই ওষুধ সংস্থাগুলির প্রায় ২২ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে এ ব্যাপারে ওষুধ সংস্থাগুলি একজোট হয়ে অধিকর্তাকে চিঠি দিয়ে জানায়, টাকা না পেলে তারা ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। তাতেও কাজ না হওয়ায় গত তিন মাসে কার্যত ইএসআই হাসপাতালগুলিতে হাতেগোনা ওষুধ পাঠিয়েছে তারা। সংস্থাগুলিই জানিয়েছে, মাসে তারা সবাই মিলে গড়ে ৭-৮ কোটি টাকার ওষুধ সরবরাহ করত। কিন্তু বকেয়া মেটানোর এই শোচনীয় অবস্থা দেখে এ বছর এপ্রিল থেকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৫০ লক্ষ টাকার ওষুধ সরবরাহ হয়েছে। সেই টাকাও কবে মিলবে ঠিক নেই। ফলে ওষুধের আকাল কোথায় পৌঁছেছে সহজেই অনুমেয়।
একাধিক ওষুধ সরবরাহকারী সংস্থার প্রধানদের কথায়, ‘‘আমাদের কারও ৫ কোটি, কারও দেড় কোটি কারও ৭ কোটি- মতো টাকা সেই অগস্ট মাস থেকে আটকে রয়েছে। এ ভাবে কতদিন ব্যবসা চালানো যায়? অধিকর্তার হাতে ৪৭ কোটি টাকা মজুত, কিন্তু তিনি কোনও অজ্ঞাত কারণে সেই টাকা ছাড়ছেন না। যক্ষের মতো আঁকড়ে রয়েছেন।’’
টাকার অভাবে ওষুধের দাম মেটাতে না পারায় কলকাতার শিয়ালদহ ইএসআই হাসপাতালে ওষুধের সরবরাহ ২০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। সেখানকার সুপার প্রদীপ ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘গত প্রায় সাত মাসে ১৬ কোটি টাকার বিল মেটাতে পারিনি। ওষুধ সংস্থাগুলি অধিকাংশ দামী, জীবনদায়ী ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন। সব রোগীদের কিনতে হচ্ছে।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘এখানে ক্যানসার রোগীদের শয্যাসংখ্যা ৮০। আউটডোরেও প্রচুর রোগী আসেন। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা তাঁদের।’’ কামারহাটি ইএসআইতে ওষুধ সরবরাহ গত তিন মাসে কমে হয়েছে ২৫ শতাংশ, বালটিকুরি-ব্যান্ডেল ইএসআইয়ে মেরেকেটে ২০ শতাংশ ওষুধ সরবরাহ হচ্ছে।
যাঁকে নিয়ে এত কিছু সেই মৃগাঙ্কশেখরবাবু কী বলছেন? তিনি হঠাৎ সরকারি টাকা আগলে যক্ষের মতো আচরণ করছেন কেন? কেন ভাঁড়ারে এত টাকা থাকতেও তা দিয়ে ওষুধের বিল মেটাচ্ছেন না?
রাজ্যের ইএসআই মেডিক্যাল বেনিফিট স্কিমের অধিকর্তার জবাব, ‘‘যক্ষ হতে যাব কেন? এখন তো কেন্দ্র পুরো টাকাটা আমাদের পাঠিয়ে দেয়। এ দিকে, এত টাকা ঠিকঠাক ভাবে বণ্টন করার মতো লোকবল বা পরিকাঠামো আমাদের নেই। অ্যাকাউন্টস বিভাগও ছোট। কোটি-কোটি টাকার এত বিল যাচাই করে ছাড়বে কে? এটা দেরির একটা বড় কারণ।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘আমার কাছে কিছুদিনের ভিতর পর পর প্রথমে ২৩ কোটি তার পর ২৪ কোটি টাকা এসে গেল। নয়ছয় এড়াতে এই সব বিল মিলিয়ে দেখে এত টাকা ছাড়তে সময় দিতে হবে। আমরা সেই প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছি। মিছিমিছি লোকে অপবাদ দিচ্ছে।’’