জোর যার: শোভাবাজার স্টেশনে ভিড় মেট্রোয় উঠতে হুড়োহুড়ি যাত্রীদের। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
ভিড়ে ঠাসা মেট্রোয় দাঁড়ানো বৃদ্ধার কাতর আর্তি, ‘‘একটু নামতে দিন। আমাকে একটু জায়গা দিন।’’ মেট্রোর দরজা থেকে হাত দু’য়েক দূরে থেকেও কিছুতেই দরজার কাছে পৌঁছতে পারছেন না তিনি। দিন কয়েক আগের কথা। রাত পৌনে ১০টা। নির্ধারিত সময়ের সাত মিনিট পরে ট্রেন এসেছিল। ভিড় ঠেলে যত ক্ষণে দরজার এক হাতের মধ্যে তিনি পৌঁছলেন, তত ক্ষণে যতীন দাস পার্ক স্টেশনে ট্রেনের দরজা বন্ধ হতে শুরু করেছে।
হাত দিয়ে দরজা আটকে বৃদ্ধাকে ঠেলে কেউ কেউ নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তাতে যাত্রীদের একাংশ চিৎকার করে উঠলেন, ‘‘উনি পড়ে যাবেন তো! ঠেলবেন না ওঁকে।’’ বৃদ্ধা কাঁদছেন। পরনের শাড়ির একাংশ তখনও আটকে রয়েছে পিছনের দুই যাত্রীর মাঝে। কেউ কেউ তাঁকে বলছেন, ‘‘পরের স্টেশনে নামবেন।’’ উদ্বেগে বৃদ্ধা বলছেন, ‘‘আমি তো চিনি না কিছু। আপনারা আমায় নামতে দিলেন না!’’
এরই মধ্যে ওই মেট্রোর দরজার কাছ থেকে ভেসে আসছে বাচ্চা ছেলের কান্নার শব্দ। ফের উদ্বেগ বাড়তে থাকে সহযাত্রীদের মধ্যে। বাচ্চাটি কি দরজায় আটকে রয়েছে? পরের স্টেশনে নামব বলে দরজার কাছাকাছি পৌঁছনোর চেষ্টা করছি। দরজা জুড়ে দাঁড়ানো যাত্রীদের ফাঁক গলে বোঝার উপায় নেই যে বাচ্চাটি কোথায়? কী বা তার অবস্থা। মেট্রোটি ছিল নন-এসি। তাই খোলা জানলা দিয়ে ট্রেনের ভিতরের চিৎকার শুনতে পেয়েছিলেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো যাত্রীরা। তাঁরাই আরপিএফ-কে ডেকে দরজা খুলে দেন। ওই বৃদ্ধাকে কোনও ক্রমে প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে দেন তাঁরাই।
তখনও কেঁদে চলেছে বাচ্চাটি। কোনও মতে তাকে মহিলাদের আসনে বসানো হল। ওর সঙ্গে কেউ আছেন কি না, তা-ও বোঝা যাচ্ছিল না! তার বাবা ছিলেন ভিড়ের মধ্যেই। পরে জেনেছি, কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাটি বাবার কোলে চেপেই নেমেছে।
কালীঘাটে নামতে রোজই ‘আসুরিক’ শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। অনেক পরে নামবেন, এমন অনেকেই ট্রেনে উঠে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন। ফলে দরজার সামনে পৌঁছতে রীতিমতো ‘যুদ্ধ’ করতে হয়। দুর্গতি আরও বাড়ে প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের জন্য। তাঁরা এমন ভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং দরজা খুলতেই ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করেন, যে নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হয় প্রায়ই। কেউ আবার নামতে না পেরে ভিড়ের চাপে কামরার আরও ভিতরে ঢুকে যান। ফলে নিজেকে অক্ষত রেখে জুতো, ব্যাগ আগলে নামাটা প্রায় দুঃসাধ্য এখন।
কারণ, মাসের পর মাস রাত ন’টার পর থেকে আপ এবং ডাউন মেট্রো নির্দিষ্ট সময় মেনে চলে না। নির্ধারিত ছ’মিনিট, আট মিনিট এবং দশ মিনিটের ব্যবধানে যে ট্রেনগুলির আসার কথা, অবধারিত ভাবে তাদের একটিও সময়ে আসে না। কখনও কখনও সেই ট্রেন আসে পরের ট্রেনের সময়ে। অর্থাৎ মাঝের একটি ট্রেন উধাও! দিনের অন্য সময়েও পরপর ট্রেন ‘বাতিল’-এর দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের।
এর জন্যই দুঃসহ ভিড়ে আতঙ্কে মেট্রোয় যাতায়াত করতে হচ্ছে যাত্রীদের।