Park Circus Firing

Park Circus Firing: ‘মনের রোগ আবার রোগ নাকি!’, এখনও কি উদাসীন থাকবে পুলিশ?

ইতিমধ্যেই থানাগুলিকে নিচুতলার কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে লক্ষ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

Advertisement

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায় ও নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২২ ০৬:৪২
Share:

ফাইল চিত্র।

মানসিক চাপ বা উদ্বেগ কমাতে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকা তো দূর, কলকাতা পুলিশে শেষ বার ‘স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ক্লাস’ হয়েছে গত ডিসেম্বরে। পুলিশ হাসপাতালেও নেই কোনও মনোরোগ চিকিৎসকের সাহায্য পাওয়ার নিয়মিত বন্দোবস্ত। কলকাতা পুলিশ সূত্রে এই তথ্যই জানা গিয়েছে। কিছু দিন আগে এ বিষয়ে জোর দিতে ভবানী ভবনে ‘ওয়েলনেস সেন্টার’ তৈরি করে মনোবিদ রাখার পদক্ষেপ করা হলেও সে ভাবে কেউই আসেন না বলে খবর। পুলিশেরই একাংশের দাবি, মনের যত্ন নেওয়ার বিষয়ে না আছে কোনও উদ্যোগ, না রয়েছে অন্য রোগের সঙ্গে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার সচেতনতা।

Advertisement

মানসিক সমস্যায় ভোগা এক পুলিশকর্মীর প্রকাশ্যে গুলি করে তাণ্ডব চালানোর ঘটনার প্রেক্ষিতেই এই সব তথ্য সামনে আসতে শুরু করেছে। যা প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে, ছোডুপ লেপচা নামে ওই পুলিশকর্মী ছুটি থেকে ফিরে কাজে যোগ দেওয়ার সময়ে কি তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটি দেখা হয়েছিল? তাঁকে বন্দুক দেওয়া হল কী করে? সেই সঙ্গেই প্রশ্ন উঠছে, কাজে যোগ দেওয়ার আগে এক জন পুলিশকর্মী মানসিক ভাবে কতটা সুস্থ, তা পরীক্ষা করা কি জরুরি নয়?

পুলিশকর্মীদের বড় অংশেরই দাবি, পরীক্ষা করা তো দূর, কাজে যোগ দেওয়ার আগে শুধু নাম নথিবদ্ধ করলেই রাইফেল কিংবা রিভলভার দিয়ে দেওয়া হয়। কাজের সময়ে শেষ হলে ওই একই পদ্ধতিতে অস্ত্র হস্তান্তরিত হয়। সমস্যা হলেও শোনার কেউ থাকেন না বলে অভিযোগ পুলিশকর্মীদের বড় অংশের। তাঁদের দাবি, এর মধ্যেই রোদ-জল উপেক্ষা করে ডিউটি করে যেতে হয়। তার উপরে ট্র্যাফিক পুলিশ কর্মীদের বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়ায় ক্রমাগত গাড়ির ধোঁয়া এবং হর্নের শব্দ। দীর্ঘদিন ধরে টানা অতিরিক্ত সময় কাজ করে যাওয়াও মানসিক সমস্যা তৈরি করে বলে পুলিশকর্মীদের দাবি।

Advertisement

উত্তর কলকাতার একটি থানায় কর্তব্যরত এক পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘আমার প্রথম সন্তান বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। আমার স্ত্রী এখন আবার সন্তানসম্ভবা। গত দু’মাস ধরে ছুটির আর্জি জানিয়ে চলেছি। কিন্তু ছুটি আর মিলছে না।’’ উত্তর কলকাতারই একটি ট্র্যাফিক গার্ডের এক পুলিশকর্মীর আবার মন্তব্য, ‘‘বাহিনীতে নিয়োগের যা অবস্থা, তাতে কিছু বলার নেই। সিভিক ভলান্টিয়ার দিয়ে কাজ তুলে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। টানা তিন মাস ১৬ ঘণ্টা করে ডিউটি করে চলেছি। এর পরে কী হবে, জানি না।’’ দক্ষিণ কলকাতার এক থানায় আবার সদ্য এক কনস্টেবলকে ‘ছুটিতে’ পাঠানো হয়েছে বলে খবর। এক জায়গায় টানা ডিউটি করতে করতে তিনি নাকি থানার ওসির সঙ্গে ‘দুর্ব্যবহার’ করে ফেলেছেন। সেখানকার এক পুলিশকর্মীর মন্তব্য, ‘‘ছেলেটি উত্তরবঙ্গের। পরিবার ছেড়ে রয়েছে। রোজ একই জায়গায় টানা ডিউটি করতে করতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে।’’

‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’র অধিকর্তা অমিত ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘পুলিশের চাকরি এমন একটি বিষয়, যার সঙ্গে বহু ধরনের মানুষকে সামলানোর ব্যাপার জড়িয়ে থাকে। এমন কাজে প্রচণ্ড চাপ থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই পুলিশের পেশায় যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে করা দরকার।’’ তাঁর পরামর্শ, ‘‘স্ট্রেস কী ভাবে হচ্ছে, সেটা দ্রুত চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এর বেশ কিছু লক্ষণ দেখা দেবে। আচমকা কম কথা বলা, যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া, আড্ডা বা অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, একা দীর্ঘক্ষণ উদাস ভাবে তাকিয়ে থাকা, আচমকা নেশা শুরু করা, অল্প নেশার অভ্যাস থাকলে হঠাৎ তা মারাত্মক বেড়ে যাওয়া বা ঘুমের সমস্যার মতো ব্যাপার দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে দ্রুত সতর্ক হতে হবে।’’ মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব বললেন, ‘‘প্রশিক্ষণের সময়ে পুলিশকর্মীদের মানসিক, শারীরিক-সহ নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু কাজের মধ্যে ঢুকে পড়ার পরে তাঁদের মানসিক সক্ষমতার উপরে সে ভাবে নজর থাকে না। তাই বছরে নির্দিষ্ট সময় অন্তর মানসিক স্বাস্থ্যের পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।’’

কিন্তু পুলিশে কি তা হয়? পুলিশকর্মীরা যদিও জানাচ্ছেন, গত ডিসেম্বরের আগে কিছু দিন ধ্যানের ক্লাস হয়েছিল। তার পরে সে ভাবে কিছুই হয়নি। ২০১৫ সালে এবং ২০০৯ সালে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথ ভাবে কয়েক দফা স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ক্লাস করানো হয়েছিল লালবাজারের তরফে। কিন্তু তার পরে প্রায় সবই বন্ধ। ঘনিষ্ঠ মহলে বহু পুলিশকর্মীই বলেন, ‘‘মনের রোগ আবার রোগ নাকি!’’

লালবাজারের যুগ্ম-কমিশনার পদমর্যাদার এক পুলিশকর্তা যদিও বললেন, ‘‘ইতিমধ্যেই থানাগুলিকে নিচুতলার কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে লক্ষ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মনের অবস্থার পাশাপাশি সমস্যার খোঁজ নিতে বলা হয়েছে। অতীতেও এ বিষয়ে বহু কর্মসূচি হয়েছে।’’ এমন ঘটনার আগেই কেন তৎপর হওয়া গেল না? এ প্রশ্নের অবশ্য স্পষ্ট উত্তর মেলেনি কোনও মহল থেকেই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement