Jadavpur University Student Death

যাদবপুরকাণ্ডের দায় থেকে বেসরকারি স্কুলের বেতন, বিধানসভায় শিক্ষা নিয়ে তর্ক, তরজায় উত্তপ্ত

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ামৃত্যুর ঘটনা থেকে রাজ্যের বেসরকারি স্কুলের বেতন নিয়ন্ত্রণে সরকারি উদ্যোগের মতো ঘটনা নিয়ে অধিবেশনে সরব হয় প্রধান বিরোধী দল বিজেপি।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০২৩ ২৩:২২
Share:

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বাদল অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্বের সূচনাতেই মঙ্গলবার দেখা গেল শাসক-বিরোধীর তুমুল তরজা। উপলক্ষ, রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় অনিয়মের অভিযোগ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ামৃত্যুর ঘটনা থেকে রাজ্যের বেসরকারি স্কুলের বেতন নিয়ন্ত্রণে সরকারি উদ্যোগের মতো ঘটনা নিয়ে অধিবেশনে সরব হয় প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। ‘জবাব’ আসে শাসক তৃণমূলের বিধায়কদের তরফেও। যার জেরে তপ্ত হয়ে ওঠে অধিবেশন। যাদবপুরের মতো পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের পড়ুয়ার মৃত্যুতে সরাসরি রাজ্য সরকারের ভূমিকাকে দায়ী করেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। জবাব দিতে উঠে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু আবার গোটা ঘটনার দায় চাপালেন রাজ্যপাল তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য সিভি আনন্দ বোসের ঘাড়ে।

Advertisement

শিক্ষামন্ত্রীর জবাবের মাঝেই অসন্তোষ প্রকাশ করে অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করে বিজেপি পরিষদীয় দল। শুভেন্দু মঙ্গলবার বলেন, ‘‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় দেশ-বিরোধী শক্তির ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। সেখানে মাদক পাচার হয়, র‌্যাগিং হয়। ঢিলছোড়া দূরত্বে থানা হলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’’ জবাব দিতে উঠে পাল্টা ব্রাত্য বলেন, ‘‘আপনারা মাদক পাচারের কথা বলছেন। এটা দেখার দায়িত্ব নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর।’’ প্রসঙ্গত, নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো কেন্দ্রীয় সংস্থা। ব্রাত্য এই কথা বলা মাত্র হইহই করে ওঠেন বিজেপি বিধায়কেরা। তাঁরা বলতে থাকেন, রাজ্যের হাতেও সংস্থা রয়েছে। সেই সময়ে বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় হস্তক্ষেপ করেন।

ব্রাত্য তাঁর জবাবি বক্তৃতায় জানান, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে ২০০৯-এর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, রাঘবন কমিটির রিপোর্টের কথাও উল্লেখ করেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি স্পষ্ট বলেন, ‘‘রাজ্যপাল নিজের ইচ্ছা মতো উপাচার্য বসাচ্ছেন। উপাচার্যকে সরিয়ে দে‌ওয়ার পরেই এই ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনার জন্য ১০০ শতাংশ দায়ী রাজ্যপাল।’’ গত ৯ অগস্ট রাতে প্রথম বর্ষের এক ছাত্র হস্টেলের তিন তলা থেকে পড়ে যায় (কারও কারও দাবি ফেলে দেওয়া হয়)। পরের দিন সকালে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। সেই সময়ে যাদবপুরে কোনও উপাচার্য দায়িত্বে ছিলেন না। গত শনিবার বুদ্ধদেব সাউকে উপাচার্য নিয়োগ করেছেন রাজ্যপাল। তাঁরও রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

Advertisement

অন্য দিকে, বেসরকারি স্কুলগুলির লাগামছাড়া বেতন বৃদ্ধি নিয়ে রাজ্যকে চাপে ফেলতে চেয়েছিল বিরোধী বিজেপি। কিন্তু মঙ্গলবার বিধানসভায় দেখা গেল, নিজেদের প্রশ্নে পাল্টা চাপে পড়ে গেল তারাই। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য তাদের জানালেন, এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই উদ্যোগী হয়েছে সরকার। এ সংক্রান্ত পদক্ষেপের জন্য বিধানসভায় একটি বিল পাশ করানোও হবে। সরকারের আশা, বিরোধীরা সে সময় ওই বিলকে বিনা বাক্যব্যয়ে সমর্থন করবে।

রাজ্যে বেসরকারি স্কুলের ফি বৃদ্ধির উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে সম্প্রতিই একটি বিলে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ ব্যাপারে নজরদারির জন্য একটি শিক্ষা কমিশন গঠনের প্রস্তাব ছিল বিলে। গত ৭ অগস্ট যা অনুমোদন পায় মন্ত্রিসভার। নতুন বিলের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বেসরকারি স্কুলের বেতন কাঠামো বেঁধে দেওয়ার জন্য তৈরি হবে একটি কমিশন। ওই কমিশনই পরবর্তী কালে ঠিক করে দেবে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ কত বেতন নিতে পারবে বেসরকারি স্কুলগুলি। এমনকি, বেসরকারি স্কুল নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের অভাব-অভিযোগও শুনবে ওই কমিশন।

বিলটি এখনও বিধানসভায় পাশ হয়নি। বিল পাশ হলে সেই বিল রাজ্যপালের কাছে যাবে অনুমোদনের জন্য। তার পর সেটি আইনে পরিণত হবে। কার্যকর হবে শিক্ষা কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া। বিরোধী দল হিসাবে বিজেপির সে কথা না-জানার কথা নয়। রাজ্য সরকারের উপর চাপ তৈরি করতেই বিজেপি বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ মঙ্গলবার বিধানসভায় এই প্রসঙ্গ তোলেন। তারই জবাবে শিক্ষা কমিশন গঠনের কথা জানিয়ে ব্রাত্য বলেন, ‘‘আশা করব, সেই বিল পাশ করার সময় বিধানসভায় আপনাদের সমর্থন আমরা পাব।’’

প্রধান বিচারপতির নির্দেশ অবহেলা?

বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু মঙ্গলবার বিধানসভায় বলেন, ‘‘বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর সিসিটিভি লাগানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি।’’ শুধু তা-ই নয়, প্রাক্তন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীর কথাও অধিবেশনে উত্থাপন করেন শুভেন্দু। তাঁর কথায়, ‘‘প্রাক্তন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী সিসিটিভি লাগাতে চেয়েছিলেন বলে আমাকে বলেছেন। কেন তাঁকে মেয়াদ শেষের আগে সরানো হল?’’

যাদবপুরে এনআইএ তদন্ত দাবি

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় মঙ্গলবার বিধানসভায় প্রস্তাব আনে বিজেপি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু বলেন, ‘‘দেশ-বিরোধী শক্তির ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে যাদবপুর। উগ্র বাম সংগঠন সক্রিয় সেখানে।’’ পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে যাদবপুরের ঘটনায় রাজ্যপালকে দায়ী করেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তার পরেই বিধানসভা থেকে ওয়াক আউট করেন বিজেপি বিধায়কেরা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনা নিয়ে মঙ্গলবার বিধানসভায় এনআইএ (জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা) তদন্তেরও দাবি জানান তাঁরা।

শুভেন্দুর প্রশ্ন, ব্রাত্যের জবাব

বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু বিধানসভায় প্রশ্ন তোলেন, ‘‘প্রাক্তন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী সিসিটিভি লাগাতে চেয়েছিলেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। কেন তাঁর মেয়াদ শেষের আগে কেন সরানো হল? মাদক পাচার চক্র এবং দেশ বিরোধী শক্তিদের সরাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? এই ঘটনার পর সরকার কী ব্যবস্থা নেবে?’’ শুভেন্দুর বক্তব্যের পর শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বলেন, ‘‘পরিবারের যে ছেলেটি চলে গেল তাকে ফেরাতে পারব না। ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কথা বলেছেন। হিমাচলে এক ডাক্তারি ছাত্রকে র‌্যাগিং করে মেরে ফেলা হয় ২০০২ সালে। রাঘবন কমিটি সেই সময় সুপারিশ করে। সেই সুপারিশ এবং আদালতের নির্দেশ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। এর পরেও দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং চলছে। খড়্গপুরে র‌্যাগিং হয়েছে।’’

দায়ী রাজ্যপাল!

যাদবপুরে ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় রাজ্যপাল বোসের প্রসঙ্গ টেনে ব্রাত্য বলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যে নতুন রাজ্যপাল এসেছেন। তিনি নিজের ইচ্ছামতো উপাচার্য বসাচ্ছেন।’’ এ কথা শুনে বিজেপি বিধায়কেরা বলেন, ‘‘আপনি র‌্যাগিংয়ের বিষয়ে কথা বলুন।’’ এর পর রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘‘রাজ্যপাল একটি নির্দেশিকা পাঠাতে পারেন। তা কার্যকর করার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের। উপাচার্যকে বসিয়ে সরিয়ে দিচ্ছেন। তার মধ্যে এই ঘটনা (যাদবপুরে ছাত্রমৃত্যু)।’’ এর পরই ব্রাত্য বলেন, ‘‘রাজ্যপাল ১০০ শতাংশ দায়ী।’’ যাদবপুরে মাদকচক্রের অভিযোগ প্রসঙ্গে ব্রাত্য বলেন, ‘‘মাদকচক্রের কথা বলছেন। এটা নারকোটিক্স ব্যুরোর দায়িত্ব।’’ ব্রাত্যের এই মন্তব্যের পাল্টা বিজেপি বিধায়করা বলেন, ‘‘রাজ্যের হাতেও সংস্থা রয়েছে।’’ শিক্ষামন্ত্রীর জবাবে সন্তুষ্ট হননি বিজেপি বিধায়করা। তাঁরা স্লোগান দিতে শুরু করেন। তার পরই বিধানসভা থেকে ওয়াক আউট করেন বিজেপি বিধায়কেরা।

বেসরকারি স্কুলে বেতন নিয়ন্ত্রণে কমিশন

রাজ্যে বেসরকারি স্কুলের ফি বৃদ্ধির উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে সম্প্রতিই একটি বিলে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সেই বিল পাশের জন্য মঙ্গলবার বিরোধীদের সমর্থন চান শিক্ষামন্ত্রী। শিক্ষা দফতর সূত্রে খবর, ওই কমিশনের নাম হবে ‘শিক্ষা কমিশন’। তবে এই কমিশন গড়ার বিলটির নাম, ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রাইভেট স্কুল রেগুলেটরি কমিশন বিল ২০২৩’। ওই বিলে বলা হয়েছে, এই কমিশনের মাথায় থাকবেন হাই কোর্টের এক জন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। যাঁকে নিয়োগ করবে রাজ্য সরকার। তাঁরই নেতৃত্বে ওই কমিশন কাজ করবে। তিনি ছাড়া ওই কমিশনের বাকি সদস্যদের মধ্যে থাকবেন রাজ্যের স্কুল শিক্ষা কমিশনার, রাজ্যের শিক্ষা সংক্রান্ত গবেষণা এবং প্রশিক্ষণ পরিষদ এসসিইআরটির অধিকর্তা, রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি, মধ্য শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি এবং দু’জন শিক্ষাবিদ। বিলে বলা হয়েছে, কমিশন বেসরকারি স্কুলগুলির নেওয়া স্কুল ফিজ় বা বেতনের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেবে। একই সঙ্গে ওই অর্থের অঙ্ক সরকারকেও জানাবে। এ ছাড়া অতিরিক্ত বেতন নেওয়া নিয়ে বেসরকারি স্কুলগুলির বিরুদ্ধে অভিভাবকদের অভিযোগও শুনবে এই কমিশন। সর্বোপরি, ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে রাজ্য সরকারের অনুমতিক্রমে প্রয়োজনে অভিযুক্ত স্কুলগুলির বিরুদ্ধে পদক্ষেপও করতে পারবে কমিশন। বেসরকারি স্কুলগুলিতে ভর্তির জন্য মাত্রাছাড়া অর্থ নেওয়ার অভিযোগ উঠছিল দীর্ঘ দিন ধরেই। এই বিল আইনে পরিণত হলে বেসরকারি স্কুলের বেতন নিয়ে অভিভাবকদের দীর্ঘ অভিযোগের সমাধান হতে পারে বলে অনুমান। তবে বিজেপি এ ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা নেবে তা নিয়ে রয়েছে কৌতূহল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement