ফাইল চিত্র।
নিয়মভঙ্গের অভিযোগ উঠছে এক সরকারি দফতরের বিরুদ্ধেই! অভিযোগ, মানসিক স্বাস্থ্য আইন না মেনে পূর্ণবয়স্ক রোগীদের সঙ্গেই নাবালক-নাবালিকাদের রাখার জন্য হাসপাতালে পাঠাচ্ছে ওই দফতরের অধীনে থাকা একাধিক হোম।
সম্প্রতি কিশলয় হোম থেকে জেলা প্রশাসনের কর্তার সই করা চিঠি-সহ তিন নাবালককে পাভলভ মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন হোম কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ, এর আগেও সুকন্যা হোম থেকে একাধিক নাবালিকাকে পাভলভে পাঠানো হয়েছিল। তাদের মধ্যে দু’জন এখনও সেখানে ভর্তি। তাদের সেখানে রাখতে এমনিতেই বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে পাভলভ কর্তৃপক্ষকে। যার অন্যতম কারণ রোগীর সংখ্যাধিক্য।
পাভলভে রোগীর সংখ্যাধিক্যের বিষয়টি বোঝা যাবে একটি পরিসংখ্যানে— ১৫০টি শয্যার ওই হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৬৫০ জন রোগী! ফলে একটি শয্যায় ভাগাভাগি করে এবং মাটিতেও রোগীদের রাখতে ‘বাধ্য’ হন পাভলভ কর্তৃপক্ষ। কারণ, কোর্ট মারফত রোগী এসেই চলে এখানে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা সত্ত্বেও রোগী আসার বিরাম নেই। ফলে শয্যা-সংখ্যার চার গুণ বেশি রোগী থাকছেন পাভলভে। অভিযোগ, পাভলভ, লুম্বিনী-সহ রাজ্যের একাধিক মানসিক হাসপাতালে পূর্ণবয়স্কদের সঙ্গে থাকতে হচ্ছে বিভিন্ন হোম থেকে পাঠানো নাবালক ও নাবালিকাকে। এই পরিস্থিতিতে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে? ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি, কলকাতার মনোরোগ চিকিৎসক সুজিত সরখেল বলছেন, “এই ব্যবস্থা শিশুর অধিকারকে খণ্ডন করছে। কোনও ভাবেই শিশু বা বয়ঃসন্ধির কিশোর-কিশোরীকে পূর্ণবয়স্কদের সঙ্গে রাখার কথা নয়। তা হলে ছোটরা ব্যঙ্গবিদ্রুপ বা যৌন হেনস্থার শিকার হতে পারে। সব সময়েই তাদের রাখার আলাদা ব্যবস্থা থাকা উচিত। আর যদি সেই শিশু বা কিশোর-কিশোরীর মানসিক প্রতিবন্ধকতা থাকে, সে ক্ষেত্রে তাদের বেড়ে ওঠার চাহিদাপূরণে পৃথক ওয়ার্ড ও প্রশিক্ষিত কর্মী রাখা জরুরি।”
কিন্তু নিয়ম না মানার কারণে ছোটদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি চিরস্থায়ী হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন মনোরোগ চিকিৎসকেরা। পাভলভের এক চিকিৎসক জানাচ্ছেন, ডাক্তারি পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সম্প্রতি সেখানে আসা তিন কিশোরেরই মানসিক প্রতিবন্ধকতা আছে। তিনি বলেন, “ওদের চিকিৎসা মানসিক হাসপাতালে হওয়ার কথা নয়। আইনত নাবালকদের রাখতেও পারি না। এ কথা বার বার জানিয়েও লাভ হয়নি।”
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা হোমগুলিতে কেন মনোবিদ নেই? কেন নিয়মিত কাউন্সেলিং করা হয় না?— প্রশ্ন তুলছেন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজার শুক্লা দাস বড়ুয়া। তাঁর মতে, “ছোটখাটো মানসিক সমস্যা হলে বহু ক্ষেত্রে কথা বলেই ঠিক হয়ে যায়। বা বহির্বিভাগে দেখিয়ে নেওয়া যেতে পারে। ভর্তির প্রশ্ন উঠছে কেন?” সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় বলছেন, “বয়ঃসন্ধিকালে আচরণগত সমস্যা থাকতেই পারে। ওরা পরিবার থেকে দূরে আছে, ওদের বিভিন্ন সঙ্কট থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ফলে সমস্যা থাকবে। তার মানে কিন্তু তারা মনোরোগী নয়। তা ছাড়া, মানসিক স্বাস্থ্য আইন অনুযায়ী, শিশু বা কিশোর-কিশোরীকে ভর্তি করা অপরাধ।” তাঁর আরও দাবি, “এই সঙ্কট কিছুতেই কাটছে না, কারণ নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের সঙ্গে সংযোগ নেই স্বাস্থ্য দফতরের! সমস্যা সমাধানে কী করণীয়, সেই নীতিগত জায়গাই তৈরি হয়নি।”
কেন বার বার এমন পরিস্থিতি? কী ভাবে সমস্যা মেটানো সম্ভব? জানতে নারী, শিশুকল্যাণ ও সমাজকল্যাণ দফতরের সচিব সঙ্ঘমিত্রা ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি, হোয়াটসঅ্যাপের উত্তর দেননি। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলেন, “এমন অভিযোগ প্রথম শুনলাম, খোঁজ নিচ্ছি। তবে মানসিক প্রতিবন্ধকতা থাকা কিশোর-কিশোরীদের মানসিক হাসপাতালে রাখা যাবে না। হোমেই পরিকাঠামো তৈরি করে চিকিৎসা করতে হবে। মানসিক রোগীদের ক্ষেত্রে অবশ্য প্রয়োজনে হাসপাতালে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। হোম ও হাসপাতালের সঙ্গে আলোচনায় বসব।”