চিকিৎসা চলছে দু’মাসের শিশুটির। নিজস্ব চিত্র।
হৃদযন্ত্রে জন্ম থেকেই সমস্যা ছিল। সেই সমস্যা এতটাই গুরুতর, যে ছোট্ট শরীরটি ক্রমশ নীল হয়ে যাচ্ছিল। বাঁচার আশা প্রায় ছেড়ে দেওয়ার পর্যায়ে চলে যায়। সেই অবস্থায় বেশ কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই অস্ত্রোপচার করেন এনআরএসের চিকিৎসকেরা। প্রায় পাঁচ ঘণ্টার জটিল অস্ত্রোপচার শেষে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দু’মাসের শিশুটি এখন ভাল আছে। আপাতত পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে ।
মুর্শিদাবাদের সায়ন মণ্ডল। গত ভ্যালেন্টাইনস ডে-তেই পৃথিবীর আলো দেখেছে। কিন্তু জন্মের সময় থেকেই তার হৃদযন্ত্রে একের পর এক সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন, হৃদযন্ত্রের দু’টি নিলয়ের মাঝে রয়েছে ছিদ্র। সেইসঙ্গে হৃদযন্ত্রের মূল ধমনীটি অপরিণত এবং সংকীর্ণ। তৃতীয়ত, হৃদযন্ত্রের মহা ধমনীতেও রয়েছে গঠনগত সমস্যা। ধমনীর শুরু এবং শেষের জায়গাটি একেবারে উল্টো ছিল সায়নের।
এমন সমস্যা থাকলে সাধারণ ভাবে জন্মের পর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে খুব বেশি হলে মাস পাঁচেক। চিকিৎসক কার্ডিয়োথেরাসিক সার্জন পরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে থেকেই সমস্যা শুরু হয়ে যায়। সঠিক চিকিৎসা না হলে মাস পাঁচেকের মধ্যে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। অনেকসময় চিকিৎসা করেও কাজ হয় না। দু’মাসের সায়নের হাতে তাই সময় ছিল কম। তার চিকিৎসার জন্য তাই ঝুঁকির কথা ভাবেননি চিকিৎসকেরা। খারাপ কী হতে পারে না ভেবে অস্ত্রোপচারের প্রক্রিয়া শুরু করে দেওয়া হয়। চিকিৎসক পরেশের নেতৃত্বেই কার্ডিওলজি এবং অ্যানাস্থেসিয়া বিভাগের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি চিকিৎসক দল তৈরি করা হয়। তারাই করে অস্ত্রোপচার। ওই বিশেষজ্ঞ দলে ছিলেন অ্যানাস্থেসিয়া বিভাগের প্রধান শম্পা দত্তগুপ্ত, চিকিৎসক বিজয় অগ্রবাল-সহ আরও বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ।
বিশেষজ্ঞ দলটি জানিয়েছে, সায়নের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল তার বয়স এবং অপরিণত শরীর। মাত্র তিন কেজি ওজন শিশুটির। অজ্ঞান করলে যে কোনও মুহূর্তে শ্বাসবন্ধ হয়ে মৃত্যু হতে পারত। সে সব জেনেও ঝুঁকি নিয়ে অস্ত্রোপচার করে চিকিৎসক দলটি। প্রথমে সায়নের হৃদযন্ত্রের ছিদ্রপথটি বন্ধ করা হয়। তারপর মহাধমনীটির গঠনগত সমস্যা মেটাতে তা নতুন করে নির্মাণ করা হয়। এক্ষেত্রে শিশুর দেহের কোষ এবং বোভাইন প্যাচের সাহায্য নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কার্ডিয়োথোরাসিক চিকিৎসক পরেশ। তৃতীয় সমস্যা অর্থাৎ মহাধমনী এবং পালমোনারি আর্টারি স্থানান্তরিত করা হয় আর্টেরেয়াল সুইচ প্রসিডিওরের সাহায্যে। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে জটিল অস্ত্রোপচারের পরে শিশুটির জ্ঞানও ফেরে।
তবে মুর্শিদাবাদের সায়নের চিকিৎসা প্রথমে শুরু হয়েছিল বহরমপুরের মেডিক্যাল কলেজে। সেখান থেকেই শিশুসাথী স্কিমে এনআরএসে পাঠানো হয় তাকে। হাসপাতালের এসএনসিইউ বিভাগে ভর্তি করা হয়েছিল সায়নকে। এত ছোট শিশুর হৃদযন্ত্রে এত জটিল সমস্যার চিকিৎসা সরকারি হাসপাতালে এর আগে হয়নি। এমনকি বেসরকারি ক্ষেত্রেও নজির বেশ কম। এ দিকে, সরকারি পরিকাঠামোয় এই জটিল অস্ত্রোপচারে সফল হওয়ায় খুশি স্বাস্থ্যকর্তারাও। তাঁরা জানিয়েছেন, এই অস্ত্রোপচার এনআরএসের মুকুটে নিঃসন্দেহে একটি নতুন পালক। তাঁদের আশা ভবিষ্যতে এ ভাবেই আরও জটিল শিশু রোগের সফল চিকিৎসা করবে এনআরএস।