পোড়া: অগ্নিদগ্ধ শরাফ ভবনে তদন্তে ফরেন্সিক দল। বৃহস্পতিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
এক মাসের মধ্যেই আবার। পর পর চার বার, শহরের চারটি জায়গায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণের পরে সামনে এল বেআইনি নির্মাণ প্রসঙ্গ। সেই সঙ্গেই দেখা গেল, দায় নিয়ে আবারও ঠেলাঠেলি। কখনও পুরসভা দায় চাপাচ্ছে দমকল দফতরের উপরে। বলা হচ্ছে, পরিদর্শন ঠিক মতো না করেই ছাড়পত্র দিয়েছে তারা। কখনও দমকল দফতর একই অভিযোগ আনছে পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের বিরুদ্ধে। বুধবার রাজভবনের কাছে শরাফ ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পরে আবারও সামনে এসেছে মেয়র এবং স্থানীয় কংগ্রেস পুরপ্রতিনিধির মধ্যে দায় ঠেলাঠেলি। যা নিয়ে অনেকেই বলছেন, ‘‘দায় যাঁরই হোক, গাফিলতি যে রয়েছে, সেটা স্পষ্ট।’’
ভুক্তভোগীদের বড় অংশেরই অভিযোগ, কোনও বাণিজ্যিক কেন্দ্র চালাতে যে অগ্নি-সুরক্ষা বিধি মানার কথা, তা মানা হয় না প্রায় কোথাওই। নিয়ম মানা হচ্ছে কি না, তা দেখারও কেউ থাকেন না। প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র দেওয়ার সময়ে পুরসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদেরও চোখে পড়ে না, বেআইনি নির্মাণ থেকে অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থার অভাব, আপৎকালীন বেরোনোর পথের জায়গায় জমে থাকা দাহ্য বস্তুর পাহাড়। এর মধ্যেই একের পর এক প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে থাকে।
সম্প্রতি যেমনটা ঘটেছে গড়িয়ার ব্রহ্মপুরে। গত ১১ এপ্রিল সেখানে একটি কাঠের গুদামে আগুন লাগে। দমকল এলেও তাদের জল শেষ হয়ে যায় বলে অভিযোগ। নতুন ইঞ্জিন আসার মধ্যে যেটুকু সময় ছিল, তার মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। প্রশ্ন ওঠে, ঘিঞ্জি এলাকায় এমন গুদাম চলার ছাড়পত্র কি পুরসভা বা দমকল দিয়েছিল? এর পরে, গত ১৩ এপ্রিল তিলজলায় একটি জুতোর কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। মারা যান দু’জন। কোনও রকম অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা ছাড়া এমন একাধিক কারখানা সেখানে চলছিল কী করে, সেই প্রশ্ন ওঠে। একই অভিযোগ সামনে আসে ২১ এপ্রিল গার্ডেনরিচের বিচালিঘাট রোডে বিস্ফোরণের ঘটনার পরেও। সেখানে একটি বাড়িতে আগুন লাগার পরে তাপে ফেটে যায় গ্যাস সিলিন্ডার। উদ্ধারকাজে গিয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়েন অনেকে। ২২ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। মৃত্যু হয় দু’জনের।
কিন্তু তার পরেও পরিস্থিতি বদলায় না কেন? নিয়ম বলছে, দমকলের ‘প্রিভেনশন’ বিভাগের আধিকারিকেরা গিয়ে সরেজমিনে সংশ্লিষ্ট বাড়ির অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা দেখে সন্তুষ্ট হলে তবেই লাইসেন্স নবীকরণ হবে। ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত বা বসতবাড়ির উচ্চতা ১৪.৫ মিটারের বেশি হলেই এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। কিন্তু শহরে ছোট কারখানা বাদ দিলেও হোটেল, হাসপাতাল, নার্সিংহোম, শপিং মল, সিনেমা হল মিলিয়ে বহুতলের সংখ্যা ছ’হাজারের আশপাশে। প্রতিটির ক্ষেত্রে বছরে এক বার দমকলের লাইসেন্স নবীকরণ করাতে হয়। সেই হিসাবে প্রতি বছর ছ’হাজার আবেদন জমা পড়ার কথা। অর্থাৎ, প্রতি মাসে গড়ে ৫০০টি। কিন্তু দমকলদফতরের আধিকারিকেরাই জানাচ্ছেন, তাঁদের যত কর্মী আছেন এই বিভাগে, তাতে মাসে ১০০টি জায়গায় গিয়েও সরেজমিনে দেখার উপায় থাকে না। এর মধ্যেই আবার প্রয়োজনে ছুটতে হয় বর্ধমান বা শিলিগুড়িতে। একই পরিস্থিতি পুরসভার বিল্ডিং বিভাগেও। সেখানকার একআধিকারিক বললেন, ‘‘কে কোথায় বাড়ির মধ্যে বেআইনি কিছু করে রাখছে, দেখার লোক কই? অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় পুরপ্রতিনিধিও জানতে পারছেন না।’’
তা হলে উপায়? রাজ্যের ‘ফায়ার অ্যান্ড ইমার্জেন্সি সার্ভিসেস’-এর অধিকর্তা অভিজিৎ পাণ্ডে মন্তব্য করতে চাননি। তিনি শুধু বলেছেন, ‘‘দমকলমন্ত্রী বিষয়টি ভাল বলতে পারবেন।’’ দমকলমন্ত্রী সুজিত বসুকে বার বার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। টেক্সট মেসেজেরও উত্তর দেননি। মেয়র ফিরহাদ হাকিমের অবশ্য দাবি, ‘‘যথেষ্ট নজরদারি চলে। রাজভবনের কাছে ওই ঘটনায় যথাযথ পদক্ষেপ করার নির্দেশ দিয়েছি।’’