দেদার: ছটপুজো উপলক্ষে ফাটানো হচ্ছে নিষিদ্ধ শব্দবাজি। বৃহস্পতিবার, ইডেন গার্ডেন্সের সামনে। নিজস্ব চিত্র
ঘরে শয্যাশায়ী স্ত্রী। কোমরের নীচ থেকে পুরো অসাড়। এর মধ্যেই ধরা পড়েছে ডেঙ্গি। চিকিৎসক বলেছেন, বাড়াবাড়ি হলে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হতে পারে। সুস্থ হতে যথেষ্ট পরিমাণ ঘুম প্রয়োজন। কিন্তু বুধবার রাত থেকে সেই ঘুমটাই উধাও। উপরন্তু, ছটপুজো উপলক্ষে পাড়ায় তারস্বরে বাজতে থাকা সাউন্ড বক্সের দাপটে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে তাঁর। শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধাকে নিয়ে যেতে হয়েছে হাসপাতালে!
স্বামী, অশীতিপর মাধব গঙ্গোপাধ্যায় বার বার থানায় ফোন করে গিয়েছেন বক্সের তাণ্ডব বন্ধ হওয়ার আশায়। কাজ না হওয়ায় শেষে ফোন করেছেন বয়স্কদের জন্য কলকাতা পুলিশের তৈরি ‘প্রণাম’ প্রকল্পের হেল্পলাইন নম্বরে। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, “তাতেও কাজ তো হলই না, বরং ভোর সাড়ে চারটে থেকে বক্সের আওয়াজ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। সকাল সাড়ে ছ’টার পরেও অবস্থা বদলায়নি। এ দিকে, আমার স্ত্রীর ওই রকম শ্বাসকষ্ট শুরু হতে দেখে অ্যাম্বুল্যান্স চেয়ে হাসপাতালে ফোন করলাম।”
বুধবার ছটপুজোর শহরে বহু বাসিন্দাকেই এমন অসহায় অবস্থায় পড়তে হয়েছে বলে অভিযোগ। দুপুরের পরে অত্যাচার কিছুটা কমলেও তাসা নিয়ে এলাকা ঘোরা শুরু হয়েছে রাত আড়াইটে-তিনটে থেকেই। কোথাও আবার রাতভর চলেছে বিশাল বিশাল সাউন্ড বক্স বাজিয়ে তাণ্ডব। সঙ্গে চলেছে দেদার নিষিদ্ধ শব্দবাজি ফাটানো। ঘটনাস্থলের কাছে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের থেকে তো বটেই, বার বার থানায় ফোন করেও কোনও সাহায্য মেলেনি বলে অভিযোগ অনেক বাসিন্দার। ব্রহ্মপুর নর্দার্ন পার্কের এক বাসিন্দার কথায়, “দুর্গা বা কালীপুজো তো ছেড়েই দিলাম, অতীতে ছটপুজোতেও এমন দেখিনি। আমাদের এই পাড়ায় বহু বয়স্ক মানুষের বাস। এখানকার মজুমদার পুকুর বলে একটি ঘাটে ছটপুজোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে সারা রাত যে ভাবে তারস্বরে বক্স বাজানো হল, তাতে বয়স্কদের বেশি সমস্যা হয়েছে।” তপসিয়ার বাসিন্দা, শহরের এক স্কুলশিক্ষিকার আবার দাবি, “উৎসবের এই মরসুমে গত আট দিন ধরেই আমাদের এলাকায় তারস্বরে বক্স বাজানো হচ্ছে। দিনকয়েকের মধ্যেই যে সিবিএসই বা আইসিএসই পরীক্ষা, সে দিকে কারও খেয়ালই নেই।”
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রের খবর, শহরের বহু জায়গায় নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে উচ্চস্বরে শব্দযন্ত্র বেজেছে। শিল্পাঞ্চলে শব্দের নির্ধারিত মাত্রা দিনে ৭৫ ও রাতে ৭০ এবং বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ ও রাতে ৫৫ ডেসিবেলের মধ্যে থাকার কথা। কিন্তু দু’ধরনের
জায়গাতেই পুজোর কয়েক দিন শব্দের মাত্রা ছিল অনেক বেশি। বসতি এলাকায়, যেখানে দিনে ৫৫ এবং রাতে ৪৫-এর মধ্যে শব্দমাত্রা থাকার কথা, সেখানে তা ছিল দিনে গড়ে ৬৮ এবং রাতে প্রায় ৭০ ডেসিবেলের কাছাকাছি। ছটপুজোর রাতে এই শব্দ-তাণ্ডব আরও মাত্রাছাড়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
কিন্তু এমন তাণ্ডব বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই উৎস থেকে বিষয়টিকে নির্মূল করতে সমস্ত ধরনের শব্দ-যন্ত্র তৈরির সময়েই তাতে সাউন্ড লিমিটর লাগানো বাধ্যতামূলক করার নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় পরিবেশ আদালত। সেই প্রেক্ষিতেই ২০০৪ সালে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড’-এর (ওয়েবেল) সহযোগিতায় রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সাউন্ড লিমিটর তৈরি করে। ওই বছরই দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, ‘খোলা জায়গায় মাইক্রোফোন চালালে বাধ্যতামূলক ভাবে সাউন্ড লিমিটর লাগাতে হবে। না হলে শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।’ ‘এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন অ্যাক্ট, ১৯৮৬’র ১৫ নম্বর ধারা এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৬৮/২৯০/২৯১ ধারা অনুযায়ী এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
তবু দিনের পর দিন শহরে এমন শব্দ-তাণ্ডব চলে কী ভাবে? লালবাজারের যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক কর্তা শুধু বলেছেন, “প্রচুর পুলিশ মোতায়েন রেখে কড়া ভাবেই সবটা সামাল দেওয়া হয়েছে।” যদিও কড়া হওয়ার নমুনা বাস্তবে দেখা যায়নি বলেই ভুক্তভোগীদের দাবি।