স্বীকৃতি: পার্ক সার্কাসের ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ্-এ দিলীপ মহলানবিশ এবং তাঁর স্ত্রী, অধ্যাপিকা জয়ন্তী মহলানবিশের নামে ওয়ার্ড। ছবি সৌজন্যে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ্।
মাত্র তিন মাস আগের কথা। ১৯ জুলাই, ২০২২। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি বইয়ের উদ্বোধনে কলকাতায় এসেছিলেন। ‘একশো তারার আলো’। বহু চিকিৎসক ও উৎসাহী মানুষের ভিড় সে দিন হো-চি-মিন সরণিতে। বাঙালি মহাজীবনের সঙ্কলন সে বই। সেখানে যে ১২ জনের নামের পাশে শুধুই জন্মসালের উল্লেখ ছিল, তাঁদেরই এক জন চিকিৎসক-বিজ্ঞানী দিলীপ মহলানবিশ, ওআরএস-এর ‘জনক’। ১৬ অক্টোবর, ২০২২, ভোরের আলো ফোটার আগেই সেই তারা খসে পড়ল।
সেই বইতে নামের পাশে লেখা ছিল, জন্মসাল ১৯৩৪। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক হন। জীবনের শেষ তিন দশক কাটিয়েছেন এই শহরেই। মাঝের সময়টিতে জিজ্ঞাসু মন ও নিরলস গবেষণার কাজে ঘুরেছেন বিশ্বে। লক্ষ্য ছিল, মানুষের শরীর ও স্বাস্থ্যের উন্নতিসাধন।
আন্তর্জাতিক মাপের এই মানুষটির সঙ্গে বেশ কিছু সময় কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছে আমার। আইসিএমআর-এর ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজ়িজ়েস’-এ এবং ওঁর নিজের গড়ে তোলা ‘সোসাইটি ফর অ্যাপ্লায়েড স্টাডিজ়’-এর সৌজন্যে। আমার টালিগঞ্জের আস্তানাতেও এসেছেন তিনি। যাঁরাই ওঁর কাছাকাছি এসেছেন, দু’-তিনটে বিষয় তাঁদের নজর এড়াত না। সদাহাস্যময় ও সৌম্য ভাব, বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি ও অসাধারণ রসবোধ। এই সব কিছুর আড়ালে জেগে থাকত এক জিজ্ঞাসু মন, যা নিয়ে মেতে উঠতেন। ভালবাসতেন ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞানের আলোচনায় যোগ দিতে। বিশ্বাস করতেন, তারুণ্যের ক্ষমতায় ও তাদের জয়গানে।
নির্দিষ্ট মাত্রায় নুন, চিনি ও জলের মিশ্রণ (ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন বা ওআরএস) তৈরি করে খাওয়ালে কলেরা আক্রান্ত রোগীর জীবন বাঁচানো যায়। ওআরএস-এর ব্যবহারিক এই প্রয়োগের বৈজ্ঞানিক তথ্যভিত্তিক প্রমাণ তিল তিল করে সংগ্রহ করেছেন চিকিৎসক মহলানবিশ। ছুটেছেন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। সে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে উদ্বাস্তু শিবিরে কলেরা রোগীদের প্রাণ বাঁচানোর এই বৈজ্ঞানিক সমাধানসূত্র গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর হাত ধরেই। এই কাজে দেশে ও বিদেশে প্রতিকূলতার সামনেও পড়তে হয়েছে ওঁকে। নামতে হয়েছে বৌদ্ধিক তর্কে।
‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজ়েশন’-এর ‘ডায়রিয়া কন্ট্রোল প্রোগ্রাম’ যে কয়েক জন মহারথীর কাঁধে ভর দিয়ে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাঁদেরই এক জন ছিলেন চিকিৎসক দিলীপ মহলানবিশ। এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন আরও বহু গবেষণা। তারই একটি, শিশুদের ডায়রিয়ার সময়ে স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়ার গুরুত্ব। শুধু শিশুরোগ চিকিৎসক হিসাবে নিয়োজিত না থেকে গবেষণার কাজে পুরোপুরি নিজেকে সমর্পণ করে দেওয়ার নজির বিশেষ পাওয়া যায় না। অথচ, এমন মানুষ চিরকাল থেকে গেলেন পর্দার আড়ালেই। তিনি এ শহরেই থাকতেন আমাদের মধ্যে, কিন্তু ক’জন চিনতেন এমন এক চিকিৎসক-বিজ্ঞানীকে? ক’জন মনে রেখেছি তাঁর অস্তিত্ব?
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাঁদের কাজ নিয়ে আলোচনা করতেন। এডস গবেষণা নিয়েও ওঁর প্রচুর উৎসাহ দেখেছি। মনে পড়ছে সেই দিনগুলোর কথা। যখন সোসাইটি ফর অ্যাপ্লায়েড স্টাডিজ়ে সন্ধ্যায় গবেষণার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করছি আমরা তিন জন, চিকিৎসক দিলীপ মহলানবিশ, আমার সহ-গবেষক হাইনার গ্রস কুরথ এবং আমি।
এক বার প্রশ্ন করেছিলাম, অল্প কথায় এত ভাল যুক্তি সাজিয়ে যে ভাবে আপনার প্রকাশিত গবেষণাপত্রগুলিতে সিদ্ধান্তে উপনীত হন, তা কে শেখালেন? হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘আমার ভাবার ও লেখার ক্ষমতার দৌড় ধরে ফেলেছিলেন স্কুলের এক মাস্টারমশাই। ভাব সম্প্রসারণ করে জমা দিলাম। মাস্টারমশাই পাশে মন্তব্যে লিখেছিলেন— চিন্তার দৈন্য সুস্পষ্ট। দেখো সমীরণ, মাত্র তিনটি শব্দ, কিন্তু কি অসাধারণ বিশ্লেষণ। সেই দিন থেকে ওই মন্তব্য মনে রেখে চেষ্টা করে যাচ্ছি ভাল করে লেখার।’ বলেই আবার হাসি।
আমি তাঁকে স্যর সম্বোধন করতাম। স্যরের এই প্রাণবন্ত ভাব থমকে গিয়েছিল ২০২১ সালে। লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের পদার্থবিদ্যার প্রাক্তন অধ্যাপিকা-স্ত্রী জয়ন্তী মহলানবিশের মৃত্যুর পরে। কোভিড মহামারি গবেষণার দায়িত্ব নিয়ে আমি তখন দিল্লিতে আইসিএমআর-এ। ফোনে কথা বললাম ওঁর সঙ্গে। বলেছিলাম, যদি আমাদের সংস্থার নতুন গবেষকদের গবেষণার নানা দিক শেখাতে রাজি হন তিনি। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া মানুষটি জানিয়েছিলেন, দু’-এক বছর আগে থেকেই উনি সভা-সমিতিতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। নানা জিনিস মনে রাখতেও অসুবিধা হচ্ছে। আমাকে চিনলেন কি না, তা-ও ঠিক বুঝিনি সে দিন। তাই আর জোর করলাম না।
১৫ অগস্ট, ২০২১। স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদ্যাপন উপলক্ষে আইসিএমআর-এর হয়ে আমাকে ভাবতে হচ্ছিল, ছোট করে ‘পাখির মুখে’র (টুইট) খবর হিসাবে কোন বিষয় তুলে ধরা যায়। ‘ডক্টর্স অ্যান্ড ডিসকভারার্স’ শিরোনামে সাত ভারতীয় চিকিৎসা-বিজ্ঞানীর সঙ্গে ছবি-সহ ছিলেন স্যর। সেটাই ছিল ওঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।
(বিজ্ঞানী, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ)